পুজোর নস্ট্যালজিয়া

“যা দেবী সর্বভূতেষু, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা…”

যেদিন ভোরবেলা রেডিওতে এক অননুকরণীয় কন্ঠস্বরে ওপরের লাইনটা বেজে ওঠে, সেইদিন থেকেই দুর্গাপূজার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়। তার আগে কয়েকটা রোববার জুড়ে গড়িয়াহাট-হাতিবাগানে পুজোর শপিং-এর জন্য যত ভীড়ই হোক না কেন, মহালয়ার স্তোত্রপাঠটা না হলে যেন পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে না ঠিকঠাক।

আমাদের বাড়িতে সন্তোষের একটা বড় রেডিও ছিল। তখনও এফএম আসেনি মার্কেটে, কাজেই রেডিওটা তখন প্রায় শো-পিস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহালয়ার দুই-তিনদিন আগে থেকে ওটাকে তাক থেকে নামিয়ে ঝাড়পোঁছ করা হত, তারপর চালিয়ে দেখা হত, যাতে মোক্ষম সময়ে বাছাধন বিগড়ে না যায়। মহালয়া শোনাটাও বেশ ঘটার ব্যাপার ছিল তখন। মনে আছে, আগেরদিন রাতে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া হত, যাতে ভোরবেলায় সবাই উঠে পড়তে পারে। চারটের সময় অ্যালার্ম বেজে উঠলেই মা আমাকে টেনে তুলে দিত। তারপর রেডিওটাকে মাঝখানে রেখে সবাই ওকে ঘিরে গোল হয়ে বসতাম। ওকে দেখে মনে হত ঠিক যেন কোনো ভিআইপি! আমি তখন নেহাৎই ছোট, ঘুমচোখে ঢুলতে ঢুলতে বাবা-মা-কাকু-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার সাথে বসে মহালয়া শুনতাম। পাড়ার অন্যান্য বাড়ি থেকেও গমগমে স্বরে স্তোত্রপাঠ ভেসে আসত। একটা অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে যেত।

আমার মহালয়া ভাল লাগার কারণটা সহজেই অনুমেয় – তার দিনপাঁচেক পরেই পুজো, আবার মহালয়ার দিন থেকেই ফুর্তির-প্রাণ-গড়ের-মাঠ হয়ে ওঠা হতনা তার কারণ – স্কুলে তখন হাফ্‌-ইয়ার্লি পরীক্ষা চলতো! ইতিহাস-ভূগোল-অঙ্ক-বিজ্ঞান নিয়ে আমি হাঁসফাঁস করতাম, আর পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে দেখতাম, পাড়ার প্যান্ডেলটা একটু একটু করে তৈরী হচ্ছে। তখন ষষ্ঠীর আগে দেবীর মুখ দেখানো হতনা, আর এখনকার মতন চতুর্থীর দিন থেকেই লোকজন ‘প্যান্ডেল হপিং’-এ বেরিয়ে পড়তো না। তাই পরীক্ষা চলাকালীন এইটুকু সান্ত্বনা অন্তত থাকতো যে আমাকে বাদ দিয়ে কেউ ফাঁকতালে ঠাকুর দেখে নিচ্ছে না।

চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন পরীক্ষা শেষ হত। সেদিন স্কুলে যেতে আর ইচ্ছে করতো না, অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতাম স্কুলের দিকে। ফেরার পথে মনের খুশী আর ধরতো না! বাসে আসতে আসতে ভাবতাম, কখন বাড়ি গিয়ে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা আর শুকতারাটা শুঁকেটুঁকে দেখবো, আর পুজোতে পাওয়া নতুন জামাকাপড়গুলো বিছানার ওপর ডাঁই করে ছড়িয়ে ঘাঁটবো। মা দ্বিতীয় বিষয়টা মোটেই পছন্দ করতো না, কিন্তু তখন আমার পরীক্ষা শেষ, পুজোর ছুটি শুরু হয়ে গেছে, কাজেই আমাকে তখন আর পায় কে! তার ওপর সেই সময়ে বাবা বাড়িতে থাকলে তো কথাই ছিলনা, দেদার প্রশ্রয় মিলতো।

সপ্তমীর দিন সকাল থেকে মোটামুটি বাড়িতে শোরগোল পড়ে যেত। দূরের এবং কাছের সব আত্মীয়স্বজনরা আসতেন বাড়িতে। জেঠু-কাকু-জেঠিমা-কাকীমা-খুড়তুতোজ্যাঠতুতো ভাইবোন – সব মিলিয়ে এক হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার শুরু হয়ে যেত। শত দুষ্টুমিও তখন মাফ হয়ে যেত, সারাদিন ভাইবোনেদের সঙ্গে হুল্লোড়বাজি, খুনসুটি, খেলা, মারামারি এইসব চলতো। প্রতি বছর ষষ্ঠীর দিন ক্যাপ ফাটানোর পিস্তল কিনতাম আমরা ভাইয়েরা, সঙ্গে ক্যাপের রোল। দিদিটা বেজায় ভীতু ছিল, তাই ওর কানের কাছে প্রচুর ক্যাপ ফাটানো হত। দিদি যত রেগে যেত আর ভয় পেত, আমাদের আনন্দ হত তত বেশী!

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে বড়রা একটু গড়িয়ে নিতেন, আমরা তখন সমান উদ্যমে ক্যারম, লুডো, চোর-পুলিশ-বাবু-ডাকাত খেলতাম। তারপর ঘড়ির কাঁটা চারটের দিকে এগোলেই ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না শুরু হয়ে যেত।

তখন শুরু হত সাজগোজের পালা, আবার একপ্রস্থ হৈচৈ। আমরা ছোটরা চেষ্টা করতাম এক ডিজাইনের জামা পড়তে। তারপর সেজেগুজে, পকেটে বন্দুক গুঁজে রেডি হয়ে থাকতাম। সবার সাজগোজ শেষ হলে ঠাকুর দেখতে বেরোনো হত। কুড়িজনের একটা দল ছিল আমাদের, ছোট-বড় সব মিলিয়ে।

তখনও থিম-পুজোর জন্ম হয়নি, সাবেকি স্টাইলের প্রতিমাই গড়তেন কারিগরেরা। উল্টোডাঙ্গার আশেপাশে তেলেঙ্গাবাগান, ধরবাগান, করবাগান, যুব বৃন্দ তখনও ‘এলিট’ গ্রুপের কল্কে পায়নি, বরং ওই চত্বরে তখন সবচেয়ে বেশি লোক টানত গৌরীবাড়ি, হাতিবাগান আর বাগবাজারের পুজো তিনটে। তবে ছোটবেলা থেকেই কটা ঠাকুর দেখা হল এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। আমার ভাল লাগতো এই সাজ-সাজ রব, আয়োজন, হুল্লোড় আর সঙ্গে অতি অবশ্যই, খাওয়াদাওয়াটা।

পুজোর ওই দিনগুলোতে সব খাবারেরই যেন অন্যরকম স্বাদ ছিল! নইলে পাড়ার গোবিন্দর দোকানের যে লাল-লাল ভেজিটেবিল চপগুলো সারা বছর আমি ছুঁয়েও দেখতাম না, সপ্তমীর দিন সবার সঙ্গে বেরিয়ে সেটাকেই অমৃত মনে হত। মনে হত, গোবিন্দর ভেজিটেবিল চপ না খেলে যেন যাত্রা শুরুই হবেনা। শুধু কি চপ, কাঁচা পরোটা দিয়ে বানানো এগরোল, আধসেদ্ধ চালের বিরিয়ানি, অর্ধেক ভাজা ফিসফ্রাই – সবই তখন স্বর্গীয় মনে হত।

একবার মনে আছে, অষ্টমীর দিন মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখে বেরিয়ে হাল্কা খিদে পেয়ে গিয়েছিল, রাত তখন দেড়টা হবে। বাবামা, জেঠু-জেঠিমা আর খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে পার্কের উল্টোদিকের একটা মিষ্টির দোকানে গরম দুধে গরম জিলিপি ডুবিয়ে খেয়েছিলাম, তার স্বাদ যেন এখনও লেগে আছে মুখে!

খাওয়াদাওয়া আর হাহাহিহি করতে করতে প্রতিবার যে আমাদের ফ্যামিলি ব্যাটেলিয়ান বাগবাজার অবধি পৌঁছতে পারতো, তা কিন্তু নয়। হাতিবাগান অবধি পৌঁছেই হয়তো সবাই হাঁপিয়ে গেল, তখন ঠাকুর দেখার লাইনে না দাঁড়িয়ে লাইন দেওয়া হত মালঞ্চের সামনে। লাইন দিয়ে ঢুকে, বেশ জমিয়ে ফিসফ্রাই-কবিরাজী ইত্যাদি সাঁটিয়ে বেরোতে বেরোতে মোটামুটি দুইঘন্টা কাবার হয়ে যেত। তখন আবার হাহাহিহি করতে করতে বাড়ির পথে হাঁটা লাগানো হত।

অষ্টমীর দিনটাও সবাই মিলে বেরোতাম। সেদিন আমাদের টার্গেট থাকতো উত্তর আর মধ্য কলকাতা। সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর মাঠে একটা সুন্দর মেলা হয় পুজোর সময়, সেখানে জলবেলুন কিনতাম। আরো একটা ব্যাপার আমার মনে আছে। সিমলার মন্ডপের অসুরটাকে যেন একটু বেশি গাট্টাগোট্টা বলে মনে হত, আমি ভাবতাম অসুরটা সমিতিতে ব্যায়াম করে বলে বুঝি ওইরকম স্বাস্থ্য!

নবমীর দিন দুপুরে পাড়ার প্যান্ডেলে ভোগ খাওয়াত। প্রায় প্রতিবছরই একইরকম মেনুঃ পোলাও, লাবড়া, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনী, রসগোল্লা আর পাঁপড়। তবে প্রতিবছর একই খাবার খেলেও খারাপ লাগতো না, বরং মাঝেসাঝে মেনু বদলে গেলে রাগই হত। সন্ধ্যাবেলা কোনো কোনো সময় বাবামায়ের সঙ্গে সল্টলেকে মাসির বাড়িতে যেতাম। সল্টলেকের পুজোয় তখন ‘বহিরাগত’ জনতা বেশি ছিলনা। ব্লকের পুজোর দর্শক মোটামুটি সেই ব্লকের জনতার মধ্যেই সীমিত থাকতো। তবে পরিস্থিতি বদলে গেল যেবার ‘টাইটানিক’ সিনেমা বেরোনোর পরে সল্টলেকের কোনো একটা ব্লকে জাহাজের আদলে প্যান্ডেল বানানো হয়েছিল। সেবারেও আমরা নবমীর দিন মাসির বাড়ি গিয়েছিলাম, টাইটানিক দেখতে। অস্বাভাবিক ভীড় হয়েছিল সেইবার, যার বেশিরভাগই বহিরাগত।

ততদিনে অবশ্য আমার ছোটবেলাও শেষ হয়ে গিয়েছিল, আর পুজোর আকর্ষণটাও বদলাতে আরম্ভ করেছিল আস্তে আস্তে। মাটির মূর্তির বদলে জীবন্ত প্রতিমাদের দিকে মনোযোগ থাকতো বেশি। চোরা চোখে তাদের সাজপোশাক আর যা যা দর্শনীয়, বয়েসের ধর্ম অনুযায়ী সেগুলো দেখতাম।

আরো বড় হওয়ার পরে অষ্টমীর দিন থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বেরোতাম, তবে প্যান্ডেল হপিং-এর বদলে আড্ডাই মারা হত বেশি – কখনও কফিহাউস, কখনও অলিপাব, কখনও ম্যাডক্স আবার কখনও বা পিটারক্যাটে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, কখনও কখনও মাঝরাত অবধি আড্ডা চলতো। বাড়ির বড়দের বয়েসও বাড়ছিল, ফলে আমাদের সপ্তমীর দিনের পারিবারিক পুজো পরিক্রমাটা বাগবাজারের বদলে হাতিবাগান, তারপর খান্না আর তারওপরে গৌরীবাড়ি অবধি কমে এসেছিল। কিন্তু একসঙ্গে বেরোনোর সেই উৎসাহটা সবার মধ্যে ছিল, যার ফলে কতদূর গেলাম, সেটার চেয়ে একসঙ্গে সকলে মিলে হৈহৈ করে চলার আনন্দটাই মুখ্য ছিল।

কলকাতায় শেষ পুজো কাটিয়েছি দশ বছর আগে। তারপর দেশে এবং বিদেশে নানা জায়গায় পুজো দেখেছি, সেখানে পুজোর আয়োজনও করেছি। কিন্তু দুর্গাপুজো এলেই যে ছবিটা এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হচ্ছে গোবিন্দর দোকানের ভেজিটেবিল চপ খেতে খেতে হাহাহিহি করতে করতে বাড়ির সবাই মিলে বেরোনোটা। আর বেরোনোর আগে ঠাকুমার কপালে হাত ঠেকিয়ে “দুগ্‌গা দুগ্‌গা” বলাটাও।

কিছু কিছু ছবি যত পুরনো হয়, তত যেন আরো বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে!

জয় মা দুর্গা!

132_bagbazar4(ছবি উৎসঃগুগ্‌ল্‌)

 

ঘটনার আড়ালে

–  আসবো স্যার?

–  না, আসবে না!

–  ভীষণ জরুরী দরকার আছে।

–  কে হে তুমি? পুলিশ, আঁতেল নাকি লুম্পেন ছাত্রনেতা?

–  আজ্ঞে না স্যার। আমি নেহাতই একজন পাতি সাংবাদিক, “ঘটনার আড়ালে” কাগজ থেকে আসছি।

–  “ঘটনার আড়ালে”? এটা আবার কি কাগজ? নাম শুনিনি তো!

–  আজ্ঞে স্যার, সবে তিনদিন আগে লঞ্চ হয়েছে আমাদের কাগজ।

–  অ! তা আমার কাছে কি মনে করে? আমি তো এখন যাকে বলে খলনায়ক নাম্বার ওয়ান।

–  আজ্ঞে, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।

–  আমার সাক্ষাৎকার? কি হবে নিয়ে? কেউ পড়বে না।

–  কি বলছেন? হুমড়ি খেয়ে পড়বে স্যার! আপনি শুধু একবার দিয়েই দেখুন না। তাছাড়া –

–  তাছাড়া?

–  তাছাড়া আমরা বিশ্বাস করি, সাদা চোখে যে ঘটনা দেখা যায়, সেটার আড়ালে অনেককিছু লুকিয়ে থাকে। কিন্তু হৈচৈ-এর ফলে সেসব পাবলিকের সামনে প্রকাশ পায়না। আমাদের ‘মটো’ হল, সেই লুকিয়ে থাকা ঘটনার উন্মোচন এবং বিশ্লেষণ।

–  বাব্বা! বেশ জম্পেশ মটো দেখছি। তা বেশ, কি জানতে চাও বল।

–  প্রথমে জানবো আপনার জীবনের কথা – আপনার আশা, আকাঙ্ক্ষা, এইসব নিয়ে কিছু যদি বলেন।

–  আশা-আকাঙ্ক্ষা কার না থাকে বলো? যারা বলে তাদের ওসব নেই, ভবিষ্যৎ সমাজ গড়াই তাদের লক্ষ্য, তারা সবাই মিথ্যে বলে, নইলে ভাট বকে। আরেবাবা, আমি কি সমাজের বাইরে? তাছাড়া, আমার মতে, চ্যারিটির মতো, প্যারিটি অলসো বিগিন্স অ্যাট হোম। আগে ঘর সামলাতে হবে, তবে না সমাজ দেখব? ঘরের বউয়ের মুখঝামটা আর ছেলেমেয়েদের গালিগালাজ খেয়ে কি সমাজ মাড়ানো যায়?

–  মোটেই না, আমি আপনার সঙ্গে একদম একমত স্যার। এবারে আপনার আকাঙ্ক্ষার কথাটা যদি বলেন?

–  ছোটবেলা থেকেই, বুঝলে, লেখাপড়ায় আমার বিশেষ এলেম ছিলনা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম, কিন্তু কুলীন কলেজগুলোতে চান্স পাইনি। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল, পড়তে পাইনি তো কি হয়েছে, একদিন-না-একদিন এই কুলীন ক্যাম্পাসে আমি ঢুকবই। সেটাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য।

–  তাহলে তো লক্ষ্যপুরণ হয়েছে আপনার, অভিনন্দন।

–  আরে বাবা, তার জন্য কি কম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, নাকি কম ছক কষতে হয়েছে? এদিকসেদিক তেল মেরে, পার্টির খাতায় নাম লিখিয়ে, চাকরিটা জুটিয়ে নিয়েছিলাম। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বোঝোই তো, লেখাপড়ার বিশেষ বালাই ছিল না। অর্ধেক সময় হুল্লোড়বাজিই হত। আমিও সেটাই চাইতাম। যত কম ক্লাস নেওয়া যায়, বুঝলে না?

–  সে তো ঠিকই। নিজের কাজগুলোও তো করতে হবে, নাকি?

–  এই যে তুমি কি সুন্দর বুঝে গেলে! অন্যেরা তো বোঝে না। সবসময় খালি আঙ্গুল করার চেষ্টা।

–  তারপর কি হল? সরকার বদলের পরে তো আপনি প্রশাসনিক পদে এলেন।

–  সে তো বটেই! সেটাই তো আমার টার্গেট ছিল। আসলে কি জানো তো, বিষয়ের ওপর ফান্ডা আমার বরাবরই কম। ক্লাসে পড়ানোর সময় ত্যাঁদোড় ছোঁড়াছুঁড়িগুলো মাঝেমাঝে এমন সব প্রশ্ন করত যে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। তাই কোনোমতে ক্লাস শেষ করে বাঁচতাম। সেইসঙ্গে তলে তলে একেবারে গ্রাসরুট লেভেলে যোগাযোগটা মেন্টেন করে গিয়েছি। তার ফলেই নতুন সরকার এসে আমাকে প্রাইজ দিল। এত যে ওদের জন্য করলাম, এটা তো আমার প্রাপ্যই ছিল।

–  অবশ্যই। তবে একটা ব্যাপার, আপনার এই পদটা তো অস্থায়ী। সেজন্য কোনো অসুবিধে?

–  না না, কি যে বলো! আর অস্থায়ীটা নামে, আসলে স্থায়ীই। এই তো গতবছরই মেয়াদ বাড়লো। তাছাড়া প্রোবাবেল স্থায়ী ক্যান্ডিডেটদের লিস্টে সবার ওপর আমার নাম আছে, বুঝলে? আর এই ঘটনার পরে তো আমি একদম নিশ্চিত, আমিই স্থায়ী হব।

–  বাঃ, আপনার এই কনফিডেন্সের জন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই।

–  ধন্যবাদ। আরেবাবা, সরকার আমার জন্য নতুন পোস্ট তৈরী করে দিয়েছিল, আর এটা তো তুচ্ছ ঘটনা।

–  সে তো বটেই। কিন্তু বিতর্কও তো আপনার নিত্যসঙ্গী – ভর্তি কেলেঙ্কারি, ট্যাবলেট কেলেঙ্কারি ইত্যাদি?

–  ছাড়ো তো! ভারি তো কেলেঙ্কারি! শোনো হে ছোকরা, আজকালকার দিনে ওরকম দু-চারটে কেলেঙ্কারি না থাকলে চলে? কেলেঙ্কারি না থাকাটা বিরাট কোনো অ্যাচিভমেন্ট বলেও আমি মনে করিনা। যারা সৎ সৎ বলে গলা ফাটায়, আসলে ধক্‌ নেই বলেই চিল্লায়। তবে হ্যাঁ, কেলেঙ্কারির পরে এন্‌কোয়্যারিটাকে ধামাচাপা দেওয়াটাই হচ্ছে আসল অ্যাচিভ্‌মেন্ট, সেটার জন্য অনেক এলেম লাগে, যা আমার আছে।

–  কিরকম এলেম একটু বলবেন?

–  দেখো ভাই, সবসময় সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতে হবে। একটু মাথা খাটিয়ে চললেই সেটা সম্ভব। আগে যে লোকটা শিক্ষামন্ত্রী ছিল, সে একটু টেঁটিয়া ছিল, নাটক-টাটক করে তো! এখন যেটা এসেছে, সেটা তো একেবারে মাথামোটা। দু’চারটে ভালো ভালো কথা বললেই ব্যাটা গলে জল! আর কি চাই?

–  সত্যি স্যার, আপনাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের।

–  হুঁ! কটা লোক আর সেটা বোঝে বল? আমাকে তো দাগী আসামীর মতন ট্রিট করছে সবাই। আচ্ছা বল দেখি, সব দোষ কি আমার?

–  তা কি করে হবে? একহাতে কি তালি বাজে? স্যার, সেদিন কি ঘটেছিল একটু যদি বলেন।

–  তেমন কিছু নয়, বুঝলে? দুদিন আগে একটি মেয়েকে কিছু ছেলে টোন কেটেছিল। সে কাটতেই পারে – জোয়ান বয়েস, রক্ত গরম, তার ওপর ওরকম খোলামেলা পোশাক দেখলে আমারই, ইয়ে কি বলে, ইয়েতে উঠে যায়, আর এদের তো নতুন ইয়ে। যাই হোক, এই সামান্য ব্যাপারটাকে মশলাটশলা মাখিয়ে, সে একেবারে যা-তা কান্ড! কমিশন বসালাম, তাতেও বাবুদের মন ভরলো না! আমাকে ঘেরাও করে ফেললো। আমাকে!

–  ঘেরাওয়ের ঘটনায় আপনি খুবই ক্ষিপ্ত দেখতে পাচ্ছি।

–  তবে নাতো কি? মামার বাড়ি পেয়েছে? দেখো ছোকরা, ক্যাম্পাসের মধ্যে, আই অ্যাম দি বস্‌। সেদিনের ছেলেছোকরা, নাক টিপলে বিয়ার বেরোয়, আমাকে ঘিরে রাখবে আর আমি চুপচাপ কম্পিউটারে বসে সলিটেয়ার খেলবো, সে বান্দা আমি নই! প্রশাসনে আছি, শাসন করা আমার কর্তব্য। নইলে তো সব গোল্লায় যাবে। তাছাড়া জানোই তো, এদিকসেদিকে কত ছাত্ররা আজকাল স্যারদের ধরে ধরে ঠ্যাঙ্গাচ্ছে। আমরা পাল্টা ব্যবস্থা নিলেই দোষ, নাকি?

–  সে তো বুঝলাম। কিন্তু ব্যাপারটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়নি কি? ছাত্ররা কি আপনাকে সত্যিই মেরে ফেলতো? আপনি তো সেরকমই অভিযোগ করেছেন পুলিশের কাছে!

–  দেখো ভাই, বসে বসে ওদের বাতেলা শুনতে শুনতে সব জ্বলে গিয়েছিল, সেইসঙ্গে ক্ষিদেও পেয়েছিল বেজায়। ক্ষিদে পেলে আমার আবার মাথার ঠিক থাকেনা। শালারা নিজেরাও খায়নি, আমাকেও কিছু খেতে দেয়নি। এইভাবে তো চলতে পারেনা। এগুলো তো অমানবিক। আর মেরে ফেলার কথা বলছ? মুখে বলেনি ঠিকই, কিন্তু মেরে দিলে কি মহিলা কমিশন আমার পাশে এসে দাঁড়াত?

–  কিন্তু তাই বলে হল্‌ অন্ধকার করে দিয়ে নির্বিচারে মারধোর করল পুলিশ, এই বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখছেন?

–  দেখো হে ছোকরা, শিক্ষাপ্রাঙ্গনে মারধোর অনেকদিন ধরে চলছে। এসব বন্ধ হওয়া দরকার। কিছু না হলেই আমাদের ঘেরাও করবে, চড় মারবে, খিস্তি করবে – এইসব আমরা আর বরদাস্ত করবো না। যা করেছি, বেশ করেছি।

–  বুঝলাম! তা এই ঘটনার ফলে আপনি কি পদত্যাগ করবেন?

–  ক্ষেপেছ? আরেবাবা, পাবলিক মেমোরি খুব উইক। কি হবে? দু’চারটে মিছিল হবে, আঁতেলরা বাক্‌তাল্লা ঝাড়বে দুদিন, ফেসবুকে বিপ্লব হবে, সুশীলরা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে বেরোবে, তারপর আবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। যত্তোসব!

–  একটা প্রশ্ন করি। খানিকক্ষণ আগে আপনি বলেছেন, এই ঘটনার পরে আপনি নিশ্চিত, যে স্থায়ী হচ্ছেনই। সেটা একটু যদি ব্যাখ্যা করেন।

–  খেয়াল করেছ দেখছি! ব্যাপারটা কিছুই না। কদিন আগেই তোমাদের শিক্ষামন্ত্রী এসে আমার কাছে কাঁদুনি গাইছিল সারদা নিয়ে। পুঁটিমাছেরা এবারে হুড়কো খেয়ে রাঘব-বোয়ালদের নাম নিচ্ছে কিনা! তাই বলছিল কোনোভাবে যদি নজরটা একটু ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। শালার লাক্‌ দেখো, ঠিক তার দুদিন পরেই এই ঘটনা ঘটে গেল! পুলিশে ফোন করার সময় আমি শুধু বলেছিলাম একটা মারকুটে অফিসার পাঠাতে, যে কিনা ডানদিক-বাঁদিক না দেখে স্রেফ ক্যালাবে। ব্যস, তাতেই কাজ হল! তারপর থেকে সারদার কথা দেখছ কাগজে?

–  না স্যার। বাপ্‌রে, আপনি তো গুরুদেব লোক মশাই। পায়ের ধূলো দিন একটু।

–  হে হে হে।

–  কিন্তু আপনি যে চাপ খেয়ে গেলেন স্যার, তার কি হবে?

–  আবার তিনদিন পরে অন্যকিছু ঘটবে! ঘটনার কি অভাব নাকি? তাছাড়া আমার চাপ নেই, আমার সরকার আমার পাশে আছে। আমি থাকব।

–  সে আর বলতে? আসি স্যার। সাক্ষাৎকারের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

–  বাই-বাই।