হোয়াটস্অ্যাপে আমাদের স্কুলের বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। সেখানে দুনিয়ার সমস্ত বিষয় – বার্বিকিউ নেশন থেকে ইউনাইটেড নেশন – নিয়েই আড্ডা হয়। আড্ডার উত্তাপ মাঝে মাঝে বেড়ে গেলে তর্ক, ঝগড়া, ভার্চুয়াল বিতন্ডা এইসবও হয়ে থাকে। তবে গোটা ব্যাপারটাই ‘খেল খেল মে’, অন্তত এখনও পর্যন্ত, তাই মজাটা পুরোদস্তুর বজায় থাকে।
গতকালও গল্পের মোড় ঘুরতে ঘুরতে কালীপুজো, কালিপটকা, চকোলেট বোম, প্রদীপ, মোমবাতি হয়ে জোনাকিতে এসে পড়ল। তখনই এক বন্ধু ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটার কথা বলল। এই কবিতাটা আমাদের পাঠ্য ছিল, আর স্কুলে বাংলার দে-টিচার এটা কিরকমভাবে পড়িয়েছিলেন সেই নিয়ে খানিকক্ষণ হাসাহাসিও হল। সেসব হওয়ার পরে, আমার মনে পড়ে গেল প্রায় বছর চোদ্দ আগের একটা শনিবারের বিকেলবেলার কথা।
সদ্য কলেজে ঢুকেছি তখন। বুকভরা আগুন ছাইচাপা হয়ে আছে, সুযোগ পেলেই সব জ্বালিয়ে দেবে – এরকম একটা হাবভাব। সিগারেটের সঙ্গে সবে আলাপ হচ্ছে, আর অলিপাবে বুড়ো সাধুটাও মাঝেমাঝে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সঙ্গদানের জন্য আছে নিষিদ্ধ মাংস দিয়ে তৈরী সসেজ। নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা – এইসব নিয়ে বেশ মজায় দিন কাটছে।
এরই মধ্যে একদিন, ডিপার্টমেন্টের একটি মেয়ে আমাদের সবাইকে ওর বাড়িতে নেমন্তন্ন করল। এমনিই, মানে এখনকার ভাষায় যাকে বলে “জাস্ট লাইক দ্যাট”। কিন্তু বিশেষত্বটা ছিল এই যে, ও শুধু ছেলেদেরই বলেছিল। সেটা কেন করেছিল জানিনা, আর ‘শুধুমাত্র মেয়েদের’ জন্যও আলাদা একটা নেমন্তন্ন ছিল কিনা, সেটাও জানিনা।
নেমন্তন্ন পেলে তখন বেশ আনন্দলাভ করতাম। এখনও করি, তবে এখন আনন্দটা নির্ভর করে হোস্টের ওপর। একান্ত চেনা লোক না হলে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আসলে বিভিন্ন জায়গায় হ্যাংলার মতন খেতে গিয়ে তার মাশুল হিসেবে হোস্টের ভাগ্নের বিয়ের সিডি/ডিভিডি দেখে কিংবা ফ্যামিলি অ্যালবামে হোস্টের মাসতুতো দিদির ভাশুরের শালার ছেলের অন্নপ্রাশনের ফোকলামুখের হাসি দেখে “স্বর্গীয়” আনন্দ লাভ করে করে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কি করব, সবাই তো আর দেখে শেখেনা, কেউ কেউ আমার মতো ঠেকেও শেখে!
দিনটা ছিল শনিবার। দুটো ক্লাস করে ‘অনেক হয়েছে’ বলে আমরা কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মেয়েটির বাড়ি ছিল তৎকালীন কলকাতার একটি অভিজাত উপনগরীতে। এলাকাটাও বেশ জমকালো, সেটা চারপাশের বাড়িগুলো দেখেই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। যাই হোক, হাসি-ঠাট্টা-ফাজলামি করতে করতে অবশেষে আমরা ওর বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বেশ সাজানোগোছানো ফ্ল্যাট। এতবছর বাদে অবশ্যই কোনো ডিটেইল মনে নেই, তবে ঢুকেই যে বেশ একটা ‘ইয়ে’ হয়েছিল, সেটা মনে আছে।
বন্ধুটি ওর বাবামায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। আমরা জনাদশেক ছিলাম সবশুদ্ধ। ওর মা একে একে সবার নামধামসাকিনঠিকানা জেনে নিলেন। আড়াল থেকে কেউ নোট নিচ্ছিল কিনা জানিনা অবশ্য!
জল চাইলাম, কোল্ড ড্রিঙ্কস এল! আমার মতে, এটা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স। জলের তেষ্টা কি আর কোল্ড ড্রিঙ্কসে মেটে? তাই আবার চাইতে হল, তখন ওর মা বললেন, “ঠান্ডা না গরম?” আমি বললাম, “যা হোক”, নইলে কে জানে, ঠান্ডা বা গরম বললে যদি জিজ্ঞেস করে বসেন “প্লেন না মিনেরাল?”
জলটল খেয়ে বেশ গুছিয়ে বসলাম সকলে। লিভিংরুমেই বসা হয়েছিল ছড়িয়েছিটিয়ে। বন্ধুর বাবামাও মেয়েকে মাঝখানে নিয়ে বসলেন। খানিকক্ষণ একথা-সেকথা চলল। মূল বক্তা ওর মা, ধরতাই দেওয়ার জন্য মাঝেমাঝে ওর বাবার কমেন্ট, আর আমরা নীরব শ্রোতা। তবে এটা বেশিক্ষণ চলেনি, মিনিট পনেরো পরেই খাওয়ার ডাক পড়ায় আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
লিভিংরুমের একপ্রান্তে ছিল ডাইনিং টেবিল। সেখানে দেখলাম পরপর বারোটা প্লেট সাজানো, তাতে চূড়ো করে বিরিয়ানি দেওয়া। কেন জানিনা, ব্যাপারটা দেখে আমার ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
মেনুতে বিরিয়ানি ছাড়াও আরো কিছু ছিল, তবে সেটা এখন আর মনে নেই। খাওয়ার সময়েও বন্ধুর বাবামা হাসি-হাসি মুখে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাই আমরা একপাল সুবোধ বালকের মতন খাওয়া শেষ করলাম। খেয়েদেয়ে, মুখটুখ ধুয়ে একটা চেয়ারে বসতে যাব, বন্ধুর মা বললেন, “তুমি তো সোফার ওই কোণায় বসেছিলে, ওখানেই গিয়ে বস”। বুঝলাম, আগেরবার যে যেখানে বসেছিল, এবারেও তাকে সেখানেই বসতে হবে, নইলে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সবাই কেমন সুড়সুড় করে যার যার জায়গায় বসে পড়ল।
উফ্ফ্, কি দাপট!
খেয়ে ওঠার পরে খানিকক্ষণ বন্ধুর দুই পাশে ওর বাবামা ছিলেন না, তাঁরা তখন খাওয়া সারতে গিয়েছিলেন। ও মাঝের চেয়ারটাতেই বসেছিল, দুদিকের চেয়ারদুটো ফাঁকাই ছিল। মনে হচ্ছিল, ছোটবেলা থেকে ও মাঝখানের চেয়ারে বসেই অভ্যস্ত। তবে দশ মিনিটের বেশি ওকে বিরহ সইতে হয়নি, তার মধ্যেই তাঁরা আবার নিজ নিজ আসনে আসীন হলেন।
খাওয়া হয়ে গেছে, কাজ মিটে গেছে। আমাদের উচিৎ ছিল তখনই কেটে পড়া। ভদ্রতা দেখিয়ে খানিকক্ষণ বসতে গিয়েই কাল হল।
বন্ধুর মা সবার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “তোমরা কেউ গানটান কর?”
সাড়ে পনেরো আনা বাজে কাজের সঙ্গেসঙ্গে গান-কবিতা নিয়ে কালচার টাইপের আধআনা ভাল কাজ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ করে থাকতো বটে। তার ওপর বন্ধুটি ‘এ ভাল গান গায়’, ‘ও ভাল কবিতা লেখে/বলে’ এইসব বলে হাঁড়ি ভাঙ্গার কাজটাও করে যাচ্ছিল সমান তালে। আমি, নির্বাণ আর গবা ছিলাম পুরো ‘অ-সাংস্কৃতিক’, তাই আমরা চুপচাপ মজা দেখতে লাগলাম।
একজন গান গাইল, দুজন কবিতা বলল – ব্যস, স্টক শেষ! এরপর বাকিরা এর-ওর মুখের দিকে ঘুঘুর মতন তাকাতে আরম্ভ করল। বন্ধুর মা বললেন, “বেশ বেশ। চর্চাটা চালিয়ে যাও, বন্ধ কোরো না কিন্তু”। এই কথা শুনে পারফর্মাররা ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল।
এমন সময় বন্ধু বলে উঠল, “মা, এবারে তুমি একটা গান গাও। সে-এ-এ-এ-এ-ই গানটা, কতদিন গাওনি!”
বন্ধুর মা সলজ্জে বললেন, “যাঃ, কি যে বলিস! কতদিন চর্চা নেই বল্ তো?”
ঘরোয়া আসরে এই কথা অবশ্য সবাই বলে থাকেন, এবং দু’একবার বলতেই তাঁরা রাজি হয়ে যান। এঁর ক্ষেত্রেও তা-ই হল। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করতে যাবেন, এমন সময় বন্ধুটি বলল, “দাঁড়াও, তোমার গানটা রেকর্ড করে নিই”। এই বলে একটা ফাঁকা ক্যাসেট টেপ-রেকর্ডারে চড়িয়ে হাসিহাসি মুখে নিজের জায়গায় বসে পড়লো।
“তোকে নিয়ে আর পারিনা” বলে বন্ধুর মা গান আরম্ভ করলেন।
গানটা ছিল ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে এই গান আমরা সবাইই শুনেছি। একটু বিলম্বিত লয়ের গান, তবে প্রতিমাদেবীর কন্ঠের জাদুতে গানটার আলাদা একটা আবেদন আছে।
কিন্তু বন্ধুর মা সেইভাবে গাইলেন না, উনি ধরলেন এইভাবে –
“বাঁ-আ-আ-আ-আ-আ-শ বা-আ-আ-আ-গা-আ-আ-ন-এ-এ-এ-এ-র মা-আ-আ-আ-থা-আ-আ-আ-আ-আ-র ও-ও-ও-ও-ও-প-ও-ও-ও-ও-র…”
করে, অতি-অতি বিলম্বিত লয়ে, ফলে কাজলা দিদি অবধি পৌঁছতেই তাঁর পাঁচমিনিট লেগে গেল!
আমরা হতবাক, নির্বাক এবং বুরবাক হয়ে বসে রইলাম। নির্বাণ পুরনো বাংলা গানটান শুনতো না বিশেষ, তাই আমার কানেকানে বলল, “এরকম বাজে গান তখন কেউ গাইতো?”
আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম, “একটা খুব ভাল গানকে উনি মার্ডার করছেন রে!”
জোরে বললেও বন্ধুর মা শুনতে পেতেন কিনা সন্দেহ, কেননা আবেগে তাঁর চোখ তখন বন্ধ, মনপ্রাণ দিয়ে বেসুরে গেয়ে চলেছেন,
“ফু-উ-উ-উ-উ-উ-লে-এ-এ-এ-এ-র গ-অ-অ-অ-অ-অ-ন্-ধে-এ-এ-এ-এ-এ ঘু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-ম আ-আ-আ-সে-এ-এ-এ-না-আ-আ-আ-আ…”
আর সেই অপার্থিব গান শুনে আমাদের সবারও ঘুম ছুটে গেছে!
ভুল বললাম।
দুজন মানুষ সেই গান খুব এন্জয় করছিলেন।
বন্ধুর বাবা যেভাবে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনি যেন তাঁর সেই যৌবনের দিনে ফিরে গিয়েছেন, দুচোখে সেই প্রথম আলাপের মুগ্ধতা। মাঝেমাঝে আবার হাঁটুতে তালও দিচ্ছিলেন।
অন্যজন আমাদের বন্ধুটি, দুই চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে নেড়ে সেও সেমি ভাবের ঘোরে চলে গিয়েছিল।
অবশেষে প্রায় মিনিট কুড়ি পরে সেই বৈপ্লবিক গান শেষ হল, শিল্পী চোখ খুললেন। গান শেষ হওয়ার খুশিতে আমরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম, আর শিল্পী সলজ্জ ভঙ্গীতে হাসিহাসি মুখে সেগুলো গ্রহণ করলেন।
কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা সেদিন সমবেতভাবেই খারাপ ছিল, কেননা হাততালি-পর্ব শেষ হতেই বন্ধু বলে উঠলো, “দেখি, রেকর্ডটা কিরকম হল”। কিছু বুঝে ওঠার আগে, এবং ওকে বাধা দেবার আগেই, ও গিয়ে টেপটা অন্ করে দিল!
চোখেমুখে ফুটে ওঠা আতঙ্কের ভাবটা আর মনে হয় লুকিয়ে রাখা গেলনা। ওরা তিনজনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আর হাঁটুতে তাল ঠুকতে ঠুকতে গান শুনতে লাগলো, অন্যদিকে আমরা পারলে দেওয়ালে গিয়ে কপাল ঠুকি! নয়েসে ভরা, ঘ্যাসঘ্যাসে কন্ঠে “কা-আ-আ-আ-আ-জ-লা-আ-আ-আ-আ-আ-আ দি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-দি-ই-ই-ই-ই-ই ক-ও-ও-ও-ও-ও-ও-ই-ই-ই-ই-ই-ই…” স্বকর্ণে না শুনলে সে আতঙ্কের মাত্রাটা বোঝানো সম্ভব নয়।
আবার কুড়ি মিনিট চলে গেল, আর এটা আগেরটার চেয়েও ভয়াবহ। তবে সব খারাপ সময়ই যেরকম শেষ হয়, এটাও সেরকম শেষ হল।
বন্ধু টেপটা বন্ধ করে বলল, “ওঃ! দুর্দান্ত! মা, তুমি জিনিয়াস”!
হঠাৎই নির্বাণ বলে উঠলো, “আন্টি, আমরা যাচ্ছি। কাজ আছে একটা”।
বন্ধুর মা এই হঠাৎ ছন্দপতনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “সেকি? এই দুপুরে আবার কি কাজ?”
আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বললাম, “সিনেমা কাকিমা, নুন শো, বিকেল পাঁচটা!”
এই বলে ভাবার বিশেষ অবকাশ না দিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে দরজার দিকে যেতে আরম্ভ করলাম, আমাদের দেখাদেখি অন্যরাও।
গবা বলে উঠলো, “আসলে আমাদের সবারই যাওয়ার কথা, ভুলেই গিয়েছিলাম!”
বন্ধুর বাবা বললেন, “একটু চা-টা খেয়ে গেলে হত না?”
পাগল! আর এক মুহুর্তও এখানে নয়। কাজলা দিদির রিপিট টেলিকাস্ট আর একবার শুনলে মরেই যাব এবার।
দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম, আর রাস্তায় নেমেই গবা নির্বাণের পিঠে একটা বিশাল কিল মেরে বলে উঠলো, “শুয়োরের বাচ্চা!”
নির্বাণের জবাব আর বাসস্টপে আসতে আসতে আমাদের বাকি কথোপকথনটা, ভদ্রতার খাতিরেই, উহ্য রাখলাম।