খবরটা শুনে একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন দুঃখহরণ কর, ওরফে ডিরেক্টর ‘ডিকে’। ওপ্রান্তের আর কোনো কথা তাঁর কানে ঢুকছিল না। এও কি সম্ভব? এই তো মাত্র দু-চারদিন আগেই কত কথা হল…হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব… ফোনেই অবশ্য, কেননা দুজনেই বেশ ব্যস্ত মানুষ, সামনাসামনি দেখা করা আজকাল আর হয়ে ওঠে না…কিন্তু হঠাৎ এ কি হল? এখনও সেইদিনকার কথোপকথনটা পরিষ্কার মনে আছে তাঁর। ফোনটা এসেছিল সন্ধ্যার সময়ে, যখন তিনি সারাদিনকার ধকল কাটানোর জন্য এক গেলাস সরবত খাচ্ছিলেন।
ফোনটা করেছিলেন তাঁর বন্ধু, ডাক্তার নবজীবন দে। দুঃখহরণের কানে এখনও বাজছে নবজীবনের গলা। প্রাথমিক কুশলাদির পরে নবজীবন বললেন
কীরে দুঃখ, তুই তো বঙ্গে বিপ্লব ঘটিয়ে দিলি! ভাবা যায়, আমাদের সেই দুঃখ!
– হেঁহেঁহেঁ। তুই টিভি দেখার সময় পাস?
– নারে, আমার আর সময় কই? রুগী দেখেই হালে পানি পাইনা। তবে তোর কথা আমি ওদের মুখেই শুনেছি রে।
– মানে? ঠিক বুঝলাম না।
– তুই তোর গল্পে এমন সব রোমহর্ষক জিনিসপত্র দেখাস যে ওইসব দেখে আমার রুগীদের প্রেশার বেড়ে যায়, মাথা ধরে, বুক ধড়ফড় করে ইত্যাদি ইত্যাদি। তা হ্যাঁরে, তোর গল্পটা কি ভূতের গল্প? কি নাম?
– না না, একেবারে সাংসারিক গল্প। নাম হল গিয়ে ‘আঁখির জলে নয়ন জ্বলে’।
– দুটোই জল? এর মানে কি?
– না রে জীবন, দ্বিতীয়টা হল জ্বলা, মানে বার্নিং।
– ওঃ আচ্ছা। গল্পটা কি নিয়ে? একটু বলা যাবে?
– গল্প…ইয়ে মানে, গল্প তো… মানে আঁখি নামের একটা গরীবের মেয়ের বিয়ে হয় নয়ন নামের এক বড়লোকের ছেলের সঙ্গে। তারপর যা হয়, শ্বশুরবাড়ীর গঞ্জনা, লাঞ্ছনা, অত্যাচার এইসব নিয়ে গল্প, মামুলি ব্যাপার।
– কি বলছিস রে ব্যাটা? তোর সিরিয়াল আমার পসার বাড়িয়ে দিয়েছে সে খবর রাখিস? একজন রোগী তো দুঃখে হাপুস নয়নে এমন কান্না আরম্ভ করেছিল যে তিনদিন ধরে টানা হিক্কে উঠেছিল বেচারার, তারপর আমার ওষুধ খেয়ে কমে। তাছাড়া হাইপ্রেশার, বুক ধড়ফড় এসবের কথা তো আগেই বললাম। তাই থ্যাঙ্ক ইউ দুঃখ, চালিয়ে যা এরকমভাবে।
– হেঁহেঁহেঁ।
ফোন রাখার পরে নবজীবনের কথায় বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন দুঃখহরণ। এই ভাবেও তাহলে লোকের উপকার করা যায়!
অন্যপ্রান্তের কাতর ‘হ্যালো হ্যালো’ ডাকে চমক ভাঙল তাঁর। ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে দুঃখ শুধোলেন, “কিন্তু হঠাৎ করে… মানে আমি তো ভাবতেই পারছি না। কি করে হল?”
ওপ্রান্ত থেকে জবাব এল, “অনেকদিন পরে বাবু আজ বাড়িতে ছিলেন, টিভি দেখছিলেন। হঠাৎ দেখি চিৎকার করে উঠলেন। তারপরেই কপালে ঘাম দিল, বুকে ব্যথা উঠলো আর প্রেশার চড়ে গেল আড়াইশোতে। তারপরই তো হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এখন কি হবে কে জানে!”
হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়াতে দুঃখহরণ জিজ্ঞেস করলেন, “কি দেখছিলেন তখন তোমার বাবু?”
অন্যপ্রান্ত উত্তর দিল, “আজ্ঞে, ‘আঁখির জলে নয়ন জ্বলে!’”।