সর্দিটা বহুদিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছে। সেই কবে ‘চতুষ্কোণ’ দেখতে গিয়ে ব্যাটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম, তারপর থেকে প্রায় তিনমাস কেটে গেছে, কিন্তু বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়েনি। মাঝেমাঝে দু’চারদিন একটু কম থাকে, ভাবি এবারে বুঝি ছেড়ে দিল আমাকে, কিন্তু কোথায় কি? ওয়ান ফাইন মর্নিং টানা ডজনখানেক হাঁচি দিয়ে বুঝতে পারি, ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। এই যাওয়া-আসা-স্রোতে ভাসার চক্করে এই কদিনে চার-পাঁচ শিশি সিরাপ সাবড়ে দিয়েছি, মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক–অ্যান্টিঅ্যালার্জিক-প্যারাসিটামল গিলেছি, বুনো তুলসীর স্বাদহীন পাতা চিবিয়েছি, গরম জলে ভেপার নিয়ে চোখের জলে-নাকের জলে হয়েছি, আঁ-আঁ করে গার্গল করে গলা ব্যথা করে ফেলেছি, কালোজিরে রুমালে পাকিয়ে শুঁকেছি – কিন্তু তা সত্বেও সর্দিকে আমার থেকে আলাদা করতে পারিনি। আমি আর সর্দি যেন ‘এক দুজে কে লিয়ে’! হতাশ হয়ে যখন ভাবছি যে অনেক হয়েছে, এবারে টোটাল গান্ধীগিরি চালাবো – অর্থাৎ আর ওষুধ খাবো না, যবে ব্যাটার ইচ্ছে হবে তবে আমাকে ছাড়বে – তখন হঠাৎ মনে হল, হোমিওপ্যাথি ট্রাই করলে কিরকম হয়?
ছোটবেলায় হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে খুব ভাল লাগতো। সেটা কতটা ওষুধের গুণে, আর কতটা ওই মিষ্টি গুলি খাওয়ার লোভে – সেটা তর্কের বিষয়। তবে মাঝে মাঝেই পাড়ার লক্ষ্মণডাক্তারের ডিসপেনসারিতে গিয়ে গুলি খাওয়ার বায়না জুড়তাম, সেটা মনে আছে। ডাক্তারবাবু বলতেন, “এমনি এমনি কি ওষুধ খেতে হয় বাবু?”
আমি দমে না গিয়ে বলতাম, “ওগুলো ওষুধ কই, চিনির গুলি তো! দাও না!”
ডাক্তারবাবুর ডিসপেনসারিতে ফ্যান ছিল না, সিলিং থেকে একটা জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলতো শুধু। গরমে ঘামতে ঘামতে তিনি কষ্ট করে ওষুধ বানাতেন, আর সেই ওষুধকে ‘চিনির গুলি’ বলাতে তাঁর রাগ হত নিশ্চয়ই। তবে আমাকে ভালবাসতেন বলে বলতেন না কিছু।
এই হোমিওপ্যাথির ব্যাপারে একটা ফান্ডা শুনেছিলাম, সেটাও লক্ষ্মণডাক্তারের মুখেই। তখন অবশ্য আমি একটু বড়, ডিসপেনসারিতে হামলা করে ‘মিষ্টি গুলি’ খাওয়ার বয়েস পেরিয়ে গিয়েছি। সেবার জ্বরে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, আর অ্যালোপ্যাথির বদলে লক্ষ্মণডাক্তারের ওষুধ চলছিল। চাপটা হল বারতিনেক গুলি খাওয়ার পরে যখন জ্বরটা কমার বদলে বেড়ে গেল। একশো থেকে একশো চার ডিগ্রীতে পৌঁছে কোঁকোঁ করছি তখন। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল। তিনি এসে আমাকে দেখলেন, তারপর মিষ্টি করে হেসে বাবাকে বললেন, “ঘাবড়াবার কিছু নেই, হোমিওপ্যাথি তো, বাড়িয়ে কমায়! চিন্তা করবেন না, সেরে গেলে ভাল হয়ে যাবে”। জ্বরটা দু-তিনদিন বাদে সত্যিই সেরে গিয়েছিল, আমিও ভাল হয়ে গিয়েছিলাম এবং তার চেয়েও আশার কথা, একশো চারের ওপরে আর ওঠেনি।
তবে ওই বাড়িয়ে কমানোর ফান্ডাটা আর পরীক্ষা করার সুযোগ পাইনি।
তাই এবারে যখন ঠিক করলাম হোমিওপ্যাথি করাবো, তখন হঠাৎ ওই ‘বাড়িয়ে কমানোর’ ব্যাপারটা মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে দমলাম না, কেননা সর্দির যা বাড়বাড়ন্ত অবস্থা, তাতে বাড়ার জায়গা নেই বললেই চলে।
শুরু করলাম হোমিওপ্যাথ ডাক্তার খোঁজা। কিন্তু এ তো আর নিজের পাড়া নয় যে টুক্ করে লক্ষণডাক্তারের চেম্বারে চলে যাব! মুশকিল হল, কাঞ্জুরমার্গের আশেপাশে কোনো হোমিওপ্যাথ ডাক্তার নেই, অবশ্য গুগ্ল্বাবার জমানায় এটা কোনো সমস্যাই নয়। নেট-এ বসে সার্চ মারতেই সবার প্রথমে ডক্টর বাত্রার সন্ধান পাওয়া গেল। দরকারের সময় কোনো দরকারী জিনিস আমার মনে পড়েনা, নইলে আরো আগেই আমার তাঁর কথা মনে পড়া উচিৎ ছিল। বিজ্ঞাপনের কল্যাণে ডক্টর বাত্রাকে আজকাল সবাই চেনে। ইন্দ্রলুপ্ত লোককে কার্তিকঠাকুর বানিয়ে দেন, চোপ্সানো গালকে ভরাট করে দিয়ে তার জেল্লা ফিরিয়ে দেন, আর আমার এই সামান্য সর্দি – হোক না আড়াই মাসের পুরনো – তিনি সারাতে পারবেন না? বাত্রার ক্ষমতাকে আন্ডার-এস্টিমেট করার কোনো মানেই হয়না, ধ্যাস্টামির একটা মাত্রা থাকা দরকার।
অতএব শনিবারের বিকেলে সটান গিয়ে হাজির হলাম বাত্রার ক্লিনিক-এ, পোয়াই অঞ্চলে। সকালেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল।
বেশ ছিমছাম চেম্বার। লোকজনের ভীড় নেই, আমি ছাড়া রুগীও নেই কেউ। দেওয়ালে ডক্টর বাত্রার হাসিমুখের ছবি দেখলাম – নিজের প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রতিভাদেবীর হাত থেকে পুরষ্কার নিচ্ছেন। দেখেশুনে মনে বেশ বল পেলাম, সর্দি এবারে সারবেই, কোনো শালা আটকাতে পারবে না। রিসেপশন থেকে রেজিষ্ট্রেশানের জন্য একটা ফর্ম ধরিয়ে দিল। নামধামবয়স ইত্যাদি লিখে ভর্তি করার মিনিটদুয়েক বাদেই ডাক পড়লো, তবে ‘কন্সাল্টেশান ফি’ বাবদ আড়াইশো টাকা নিয়ে নিয়েছিল অবশ্য নাম ডাকার আগে। নাক টানতে টানতে গিয়ে হাজির হলাম ডাক্তারবাবুর কাছে।
গিয়ে দেখলাম, বাবু নন, তিনি বিবি। তেমন সুন্দরী নন, তবে চেহারায় একটা লাবণ্য আছে। আমাকে আলাদা করে আর সমস্যার কথা বলতে হলনা, নাক টানতে দেখে তিনি নিজেই রোগটা বুঝে গেলেন। তবে রোগের গভীরতা বোঝার জন্য আমাকে ডজনদুয়েক প্রশ্ন করলেন, সেইসঙ্গে ঝড়ের গতিতে টাইপ করে চলেছিলেন।
প্রশ্নোত্তরের পালা শেষ করে তিনি বললেন, “ওকে, আপনার রোগটা ক্রনিক ধরণের। একে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হবে, সেজন্য ট্রিটমেন্টের দরকার। মাসে একবার করে আসতে হবে, আর এই চিকিৎসা এক বছর চলবে”।
এক বছর! শুনেই কিরকম ট্যান খেয়ে গেলাম। ততদিন ধরে নাক টানতে হবে? আমার ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে বোধহয় তাঁর মায়া হল, অল্প হেসে বললেন, “চিন্তার কিছু নেই। যদি ছয় মাসে আপনি সেরে ওঠেন, তাহলে তো ভালই, বাকি ছয়মাস ওষুধ খেতে হবেনা। এখন যান, রিসেপশনে গিয়ে এক বছরের প্ল্যানে এনরোল করে ফেলুন। তারপর আমরা আবার বসব, আপনার কেস হিস্ট্রি্টা বানিয়ে ফেলব, দেন উই উইল স্টার্ট ইয়োর ট্রিটমেন্ট”।
ওরেব্বাস, এখানে আবার প্ল্যানও আছে? অবশ্য হবে না-ই বা কেন? হুঁ হুঁ বাওয়া, এ কি আর লক্ষ্মণডাক্তারের চেম্বার, যে দুটো পুরিয়া দিয়েই ছেড়ে দেবেন? তবে কেসহিস্ট্রি বানাবেন শুনে একটু থমকে গেলাম – আরও কতগুলো প্রশ্ন করবেন কে জানে!
যাই হোক, রিসেপশনে ফিরে এলাম। একজন শুকনো চেহারার লোক বসেছিলেন। তিনি কি-বোর্ডে হাত রেখে, আর আমার মুখের ওপর চোখ রেখে, বললেন, “এক বছরের প্ল্যানে এনরোল করুন। এমনিতে পনেরো লাগে, তবে আপনাকে ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছে, বারোয় হয়ে যাবে”।
আমি নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “বারোশো? একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না?”
লোকটা আমার প্রশ্ন শুনে, যাকে বলে, একেবারে ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে গেলেন। ব্যোমকে গিয়ে বললেন, “সরি স্যার। ওটা বারোশো নয়, বারো হাজার”।
মাথাটা কিরকম ভোঁ করে ঘুরে গেল আমার! বারো হাজার টাকায় মুম্বই থেকে কোলকাতা প্লেনে গিয়ে, লক্ষ্মণডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে, আবার প্লেনে করে ফিরে আসা যাবে না?
বারো হাজার টাকা দিয়ে এক বছর ধরে সর্দির ওষুধ খেতে হবে?
এ কি বাত্রা, না জলজ্যান্ত খত্রা?
আর কোনো কথা না বলে আমি অ্যাবাউট-টার্ন মেরে হাওয়া! কাউন্টারের ভদ্রলোকটি আরো কিছু বলছিলেন, আমি আর সেসবে কান দিইনি।
বাইরে বেড়িয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেইসঙ্গে লক্ষ্মণডাক্তারের কথা আবার মনে পড়ে গেল।
সেই ফ্যানহীন ডিসপেনসারি…হলুদ রঙের টিমটিমে বাল্ব…ঘর্মাক্ত কলেবরে ডাক্তারবাবু পুরিয়া বানাচ্ছেন…
গত তিরিশ বছরে তাঁর ভিজিট কুড়ি টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে আশি টাকা হয়েছে…
পুনশ্চঃ বাত্রার ক্লিনিক থেকে ফিরে এসে, খুব অবাক হয়ে দেখলাম, সর্দিটা আর নেই। ওষুধ খেতে হয়নি, ‘ফি’ শুনেই রোগ পিঠটান দিয়েছে। যাক্ বাবা!
পড়ে হাসতে হাসতে পেট ফেটে গেল। এই ডক্টর বাটরা যে কত বড় জোচ্চোরের আখড়া বলে বোঝানো কঠিন। কত লোকের যে মাথায় টুপি পরাচ্ছে ওপরওয়ালাই জানেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে এরা এখনো ব্যবসাতে টিকে আছে। ইন্টারনেটে কিন্তু অনেক বাজে রিভিউ দেখতে পাবে।
কদিন কড়া রোদে ঘোরো বা দৌড়ঝাঁপ করে ঘাম ঝরাও। সঙ্গে সঙ্গে স্টিম ইনহেলেশন। সেরে যাবে। 🙂
একদম ঠিক বলেছ তথাগতদা, পুরোটাই চোট্টামো চলছে মনে হয়।
সর্দি এখন আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল, আশা করি জলদি ঠিক হয়ে যাব। 🙂
কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ।
দারুণ গল্প, অরিজিত। লেখাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। আর একটা কথা বলা হয়নি, আপনার সাইটের এই চেহারাটা আমার পছন্দ হয়েছে খুব। আগের চকবোর্ডটাও ভালো ছিল, কিন্তু কালোর ওপর সাদা লেখা পড়তে সামান্য অসুবিধে হত। এটার সেই অসুবিধে নেই।
অনেক ধন্যবাদ কুন্তলা, লেখা ভাল লেগে কমেন্ট করার জন্য, আর ব্লগের চেহারা ভাল লাগার জন্যও। 🙂
সাধু!! সাধু!!!
অনেক ধন্যবাদ অনির্বাণদা, অনেকদিন পরে কমেন্ট পেয়ে খুব ভাল লাগলো। 🙂
Amar baba o homeopathy doctor. Fee apatoto 10 taka. Baro hajari golpo sunle definitely ghabre jabe.
আপনার বাবাকে গল্পটা নিশ্চয়ই বলবেন রোশনী। 🙂
আমি তো এবারে বাড়ি গিয়ে লক্ষ্মণডাক্তারকে গল্পটা বলবই।
Arijit, apnar sordi ta allergy ghotito noyto.. Ami ek araimashi sordi sarate ENT er kachhey giye khobor pelam amar ta bagha allergy. Tai ekta medicine e hobe na, khan tinek osudh r drop chai daily. Apni ekbar ENT route ta try kore dekhte paren
ENT ট্রাই করতে হয়নি রোশনী, বাত্রার কাছ থেকে ফিরেই সর্দিটা সেরেই গেছে প্রায়, শক থেরাপী হয়েছে মনে হয় আমার। 😀
besh moja laglo porey 🙂 bneche thakuk apnar lakshman dactar 🙂
যা বলেছ পৌষালী। 🙂
কমেন্টের জন্যে ধন্যবাদ।
sordi kashi niyeo besh jomjomat lekha ….aar Dr Batra dekhiye diyeche je eta marketing er juug…..oshadharon
ধন্যবাদ সিধু। 🙂
tomar lekha ta pre onek purano kotha money koriye dilo . Bisheshto Laxman doctor er kotha ta . Er ekta kotha sardi onekkta Sholay er joy er viru er moto ekbaar dhorele er charte chay naa . jemon amake 1 maas dhore mritrar bandhane bedhe rekhechchen
হক্ কথা! সে কি, তোকেও ধরেছে? শিগগির ছাড়া, তবে বাত্রার কাছে যাস না যেন!