ইদানিং সোম থেকে শুক্র এমন হুড়মুড় করে চলে যাচ্ছে যে একটা দিনের সঙ্গে অন্য দিনের কোনো তফাৎ করতে পারছি না। সেই সকালে গলায় বকলস ঝুলিয়ে গেট দিয়ে ঢুকি, আর রাতে বেরোনোর সময় বকলসটাকে পকেটে রেখে মনে মনে বলি, ‘ওয়ান ডাউন, ফোর টু গো’। এইভাবে চারদিন গুনতি করার পরে শুক্রবারের সন্ধেটা আসে, আর তখন মনের মধ্যে যে আনন্দটা হয়, সেটা স্কুলে পড়াকালীন পুজোর ছুটি পড়ার চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং বেশিই।
এই শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হল, আজ একটু কাজকর্ম করলে কেমন হয়? নর্মালি উইকএন্ডগুলো আমি ল্যাদ খেয়ে আর খাবার খেয়েই কাটিয়ে দিই, কিন্তু শনিবার ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে কর্মবীর বলে মনে হচ্ছিল। তবে ‘কাজকর্ম’ বলতে কেউ যেন আবার ঘরগৃহস্থালি গোছগাছ বা রান্নাবান্নার কথা না ভাবে। ওসব নিত্যকর্ম পদ্ধতি, কাজকর্মের আওতায় ওরা আসেনা।
সকালে চা খেতে খেতে গিন্নিকে আমার এই ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করলাম। শুনে অবধারিতভাবে প্রশ্ন এল, “কি ধরণের কাজকর্ম করার কথা ভাবছ তুমি?”
তখনও অবধি কোনো প্ল্যান আমার ছিলনা, কিন্তু আমার গিন্নি আমার চেয়ে ঢের বেশি গোছানো, তাই একটা প্ল্যান – ফুলপ্রুফ না হয়ে টেন্টেটিভ হলেও চলবে – ওকে শোনাতে না পারলে সেটা পাস হওয়ার চান্স খুবই ক্ষীণ। আমি একটু সময় নিয়ে চায়ের কাপে দুটো চুমুক মেরে, সিগারেটে দুটো টান দিযে, গিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গিন্নি বলল, “আমি মনে হয় একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে!”
সব প্রশ্নের যে উত্তর হয়না, সেটা ওকে কে বোঝাবে? আমার সামনে সিনেমার পাতাটা খোলা ছিল, সেদিকে তাকিয়ে বললাম, “‘রয়’টা দেখা হয়নি। ওটা দেখতে যাব ভাবছিলাম”।
এরকম একটা পানসে কাজের কথা শুনে বিরসমুখে জবাব এল “অ! শো কটায়?”
“সোয়া তিনটে!”
“তোমার যা নিড়বিড়ে স্বভাব, খেতে খেতেই তো তিনটে বাজিয়ে দেবে তুমি, মানে তাইই দিয়ে থাকো। তারপর সোয়া তিনটের সময় সিনেমা দেখতে যাবে? তখন তো বলবে ‘ঘুম পাচ্ছে’!”
আমার একটা মহৎ গুণ আছে, আমি সত্যি কথার প্রতিবাদ করিনা। গিন্নি কথাটা ভুল বলেনি। সন্ধে ছটার শো-তেই আমার ভাতঘুমের জন্য যাওয়া হয়নি, আর এ তো সোয়া তিনটে! মাথাটাথা চুলকে বললাম, “না না, আজ যাবই। তাছাড়া আমি ভাবছিলাম…!”
আমার গিন্নি কথার মাঝখানে তিন সেকেন্ডের বেশি ‘পজ’ ভালবাসেনা, আর আমি ‘পজ’ মেরে মেরেই কথা বলে থাকি, কেননা আমার ‘ভাবনা’গুলোকে কথায় প্রকাশ করতে সময় লাগে। তাই এবারেও আধ মিনিট পরে ভাবনাটা খুঁজে পেলাম, বললাম, “…লাঞ্চটা যদি বাইরে করা যায়?”
আমার আধমিনিটের ‘পজ’ গিন্নির নিষ্পৃহতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফেলেছে ততক্ষণে, তাই বিরসতর একটা জবাব এল, “অ! হোম ডেলিভারি?”
আমি ঝটিতি জবাব দিলাম, “না না, তা কেন? ভাবছিলাম…’করিমস্’ যাব!”
এত তাড়াতাড়ি ভাবনায় কথা ফুটতে দেখে আমি বেশ চমৎকৃত হলাম, আর আড়চোখে দেখলাম, গিন্নির মুখে হাসি ফুটেছে। আমি দ্রুতগতিতে বলে গেলাম, “’করিমস্’-এ খেয়ে, সিনেমা দেখে, তারপর আরো যদি কিছু করার থাকে সেসব করে, বাড়ি ফিরব”।
প্ল্যান পাস হয়ে গেল।
***
অনেকের কাছেই শুনেছিলাম, ‘করিমস্’-এ নাকি ফাটাফাটি রোল আর কাবাব পাওয়া যায়, পোয়াইয়ের ‘গ্যালেরিয়া মল্’-এ ওদের আউটলেট। এর আগে একবার হোম ডেলিভারি অর্ডার করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ওরা হাজার টাকার কমে বাড়িতে ডেলিভারি দেয় না, আর দুজন মিলে তো আর আট-দশটা রোল খাওয়া যায়না, তাই বিষয়টা আটকে ছিল এতদিন।
হিরানন্দানির “গ্যালেরিয়া মল্” এক আজব জায়গা। এর দোতলায় দুপাশে সারি-সারি খাবারের দোকান, আর মাঝখানে রাশিরাশি চেয়ার-টেবিল পাতা, গণ-লঙ্গরখানা যাকে বলে। মাথার ওপর খানিকটা ছায়া আছে, বাকিটা খোলা আকাশ। ‘করিমস্’-এর সামনে পৌঁছে গিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর খোলা আকাশ, ছায়া নেই। পেটুক হয়ে জন্মেছি, সামান্য রোদে ভয় পেলে চলবে? তাই গুছিয়ে বসে গেলাম, আর মেনুকার্ডও এসে গেল সাথে সাথে।
রোলটা খাব ঠিক করেই এসেছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে কাবাব না বিরিয়ানি, সেটা নিয়ে একটু ধন্ধে পড়ে গেলাম। বিরিয়ানির প্রতি আমার একটা অদ্ভুত হ্যাংলামো আছে, আর সেই হ্যাংলামোর জন্য অনেক জায়গায় অনেক ভুলভাল বিরিয়ানিও খেয়েছি আমি – ঝালঝাল বিরিয়ানি, মশলা দেওয়া লাল রঙের বিরিয়ানি, গ্রেভিওয়ালা গ্যাদ্গ্যাদে বিরিয়ানি ইত্যাদি প্রভৃতি। অবশেষে ‘হ্যাংলা’র বিরিয়ানিতেই স্থিতু হয়েছি আপাতত। ওদের বিরিয়ানিতে একটা কলকাত্তাইয়া ব্যাপার আছে, আলু-ডিম সমেত জিনিসটা দেখতে খাসা।

যাই হোক, অনেক ভাবনাচিন্তা করে অবশেষে রোলের সঙ্গে বিরিয়ানিই অর্ডার করা হল। গিন্নি একটু দোনামোনা করছিল বটে, কিন্তু আমি দমিনি। আগে রোলটা দিয়ে গেল, আর সেটা খেয়ে একেবারে ফিদা হয়ে গেলাম, পুরো জান্নাত-জাহান্নাম একাকার হয়ে যাওয়া যাকে বলে। আশা বাড়ল, সঙ্গে প্রত্যাশাও – যারা এরকম রোল বানাতে পারে, তারা বিরিয়ানিও নিশ্চয়ই ভাল বানাবে।
কিন্তু বিরিয়ানিটা যখন দিয়ে গেল, তখন বেশ হতাশ হলাম, চেহারাটা মোটেই আমার পছন্দ হলনা, আর খেয়েও মন ভরল না। সেই মশলাভাত-মার্কা ব্যাপার, গুচ্ছের পাতা দেওয়া, তাও ভাল ঝালটা নেই!

বিরিয়ানিটা খেতে খেতে গিন্নির দিকে একবার তাকালাম। নির্বিকারে খেয়ে চলেছে, কিন্তু চোখেমুখে একটা চাপা জয়ের হাবভাব। করিমচাচা যে এরকমভাবে ঝোলাবে কে জানতো!
খাওয়াদাওয়া সেরে যখন উঠলাম, তখন প্রায় পৌনে তিনটে বাজে। অটো ধরে যখন হল্-এর সামনে এলাম, তখন তিনটে বাজে।
***
‘হুমা সিনেমা’টা আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেক, আর হিন্দি সিনেমা দেখতে হলে আমরা এখানেই আসি। টিকিটের দাম অন্যান্য মাল্টিপ্লেক্সের তুলনায় অনেক কম, তাছাড়া হাঁটাপথ বলে দেরি হলেও বাড়ি ফেরার চিন্তাটা থাকেনা। মাল্টিপ্লেক্স আবির্ভাবের শুরুর দিকের ইমারত এটা, তাই বাহারি দেখনদারি ব্যাপারস্যাপার নেই, বরং অন্যান্যদের তুলনায় বেশ ম্যাড়ম্যাড়েই বলা চলে।
যাই হোক, কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখি আমার সামনে তিন-চারজন লোক, আর সবাই “বদলাপুর”-এর টিকিট কাটছে। আমি “রয়”-এর টিকিট চাওয়াতে কাউন্টারের মহিলাটি বললেন, “টিকিট হবে না”।
আমি ঘাবড়ে গেলাম, বললাম, “হবে না কেন? শো হাউসফুল বুঝি?”
মহিলা বললেন, “না। হবে না মানে, তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে”।
আমি বললাম, “কেন? শো কি দেরিতে শুরু হবে?”
প্রশ্নটা করার কারণ ছিল। আগে একবার “হ্যাপি নিউ ইয়ার” দেখতে এসে সিনেমা একঘন্টা দেরিতে আরম্ভ হয়েছিল, প্রেক্ষাগৃহের বাতানুকুল যন্ত্র খারাপ থাকার জন্য।
মহিলা বললেন, “না। আসলে টিকিট বিক্রি হয়নি, তোমরা দুজনেই প্রথম!”
এটা শুনে যাকে বলে একেবারে ব্যোমকে বিয়াল্লিশ হয়ে গেলাম। সবে এক হপ্তা হয়েছে সিনেমা রিলিজ করেছে, তার ওপর রণবীর কাপুরের সিনেমা, তার এই দশা? মুখে কথা সরল না, খানিকক্ষণ হুব্বা হয়ে থেকে শুধোলাম, “তাহলে কি করব?”
মহিলা বললেন, “কি আবার করবে? অপেক্ষা করতে পারো, দেখো যদি দর্শক আসে!”
তখন প্রায় তিনটে দশ বাজে। বাকি পাঁচ মিনিটে সিনেমা চালু করার মতন দর্শক এসে যাবে, সেটা ভাবাটা বাড়াবাড়ি। তাই গিন্নিকে বললাম, “কি করবে?”
গিন্নি বলল, “দুটোই তো অপশন, এখানে ঠগার মতন দাঁড়িয়ে থাকো, আর নইলে বাড়ি চল!”
এরপর কি আর কিছু বলার থাকে?
***
বাড়ি ফিরে মনের দুঃখে ঘুমিয়েই পড়লাম। আমার প্ল্যানটা যে এভাবে মাঠে মারা যাবে, সেটা কি করে জানব? রণবীর-অর্জুন-জ্যাকলিন মিলে কি এমন সিনেমা করেছে যে দ্বিতীয় উইকএন্ডেই হল্-এ দর্শক হয় না? মনে মনে ঠিক করলাম, “রয়” আমাকে দেখতেই হবে! ব্যাপারটাকে ‘টু-ডু’ লিস্টে ফেলে দিলাম।
ঘুম থেকে উঠে ল্যাপু ঘাঁটতে ঘাঁটতে ‘বুকমাইশো’-তে ঢুকে দেখি, ‘আরসিটি মল্’-এ “এবার শবর” চলছে। ক্লিক করে দেখলাম, দর্শক ভালই হয়েছে। সেটা হওয়ারই কথা অবশ্য। মুম্বইয়ের বঙ্গসমাজ এসব ব্যাপারে খুব কো-অপারেটিভ। নিশ্চিন্ত হয়ে গিন্নিকে বললাম, “চল গিন্নি, “এবার শবর” দেখে আসি”।
ভেবেছিলাম লাঞ্চ আর ম্যাটিনির সেই ধাক্কার পরে রাজি হবে না বোধহয়, কিন্তু অবাক ব্যাপার, এককথায় রাজি হয়ে গেল। সাড়ে আটটায় শো ছিল, সময়মত পৌঁছে গিয়ে আরামদায়ক গদিতে বডি ছেড়ে দিলাম।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “ঋণ” উপন্যাস অবলম্বনে অরিন্দম শীল এই সিনেমাটা বানিয়েছেন। অরিন্দমের আগের ছবি “আবর্ত” আমার বেশ ভাল লেগেছিল। তার ওপর শীর্ষেন্দুর গল্প, আর নামভূমিকায় শাশ্বত, কাজেই সিনেমাটা খারাপ হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
হয়ওনি!
মিতালী ঘোষ নামে এক তরুণী তার নিজের বাড়িতে এক রাতে খুন হয়, যার তদন্ত করতে নামে লালবাজারের গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত। খুনের রাতে মিতালীর বাড়িতে একটা পার্টি হয়েছিল, যেটা শেষ হওয়ার পরেই মিতালীকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।
তদন্তে নেমে শবর বুঝতে পারে, সাসপেক্ট অনেকে – মিতালীর দুই প্রাক্তন স্বামী মিঠু মিত্তির আর পান্তু হালদার, মিতালীর ছেলেবেলার বন্ধু সমীরণ বাগচী, তার প্রেমিকা ক্ষণিকা, মিতালীর খুড়তুতো বোন জয়িতা, আর একজন রহস্যময় কলগার্ল জুলেখা শর্মা। তদন্ত চলতে থাকে, এবং পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন নানা ঘটনা-প্রতিঘটনা সামনে আসতে থাকে।
মার্ডার মিস্ট্রি, তাই বাকিটা বলার কোনো মানে হয়না। তবে পদ্মনাভ দাশগুপ্ত আর অরিন্দম শীলের চিত্রনাট্যের গুণে ছবির গতি কখনোই কমেনি। সংলাপও বেশ মজাদার এবং টানটান। শুরুতে অনেক চরিত্রের আবির্ভাবে গল্পটা একটু জটিল মনে হলেও পরের দিকে ফলো করতে কোনো অসুবিধে হয়না। একদম শেষ অবধি সাসপেন্সটা বজায় থাকে, এবং সবচেয়ে ভাল ব্যাপার, রহস্যের যবনিকা পড়ে খুব সুন্দরভাবে, এবং লজিক্যালি।
ছবির স্টারকাস্ট দুর্দান্ত, এবং অভিনয়ে সবাই মাতিয়ে দিয়েছেন। স্বস্তিকা, পায়েল, জুন, দেবলীনা নিজের নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে একটু চড়া অভিনয় হলেও, মোদ্দা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য।
পুরুষেরা সকলে ফাটাফাটি। আবীর, রাহুল, ঋত্বিক, শুভ্রজিত সকলেই অনবদ্য। ছোট চরিত্রে দীপঙ্কর দে, রজত গাঙ্গুলী এবং নিত্য গাঙ্গুলীকেও ভাল লাগে।
তবে এই ছবির মূল আকর্ষণ শবরের চরিত্রে শাশ্বত। বর্তমানে যে কজন অভিনেতা আছেন টালিগঞ্জে, তার মধ্যে শাশ্বতকেই আমার শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। শাশ্বতর প্রতি আমি অনেকটাই ‘বায়াসড্’, কিন্তু কথাটা খুব ভুল বললাম না বলেই মনে হয়। “এবার শবর”-এ জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত একটা নির্লিপ্তি নিয়ে অভিনয় করেছেন ভদ্রলোক। হাঁটাচলা, কথাবার্তা, ম্যানারিজম – এইসব দেখেশুনে শবরকে ভাল না লেগে কোনো উপায় নেই।
আশা করা যায় অরিন্দম শবরকে নিয়ে আরো কয়েকটা ছবি বানাবেন। না বানালে, আমি অন্তত খুব দুঃখ পাবো।
***
বাড়ি ফিরে বেশ ভাল লাগলো। দিনের প্রথমার্ধটা যেরকম বাজেভাবে গিয়েছিল, শেষটা অন্তত তার চেয়ে অনেক ভাল হল।
মর্নিং ডাস নট, অলওয়েজ শো দ্য ডে!
শোবার আগে শীর্ষেন্দু, শাশ্বত আর শীলদাকে তিনটে ধন্যবাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
(ছবি উৎসঃ গুগ্ল্)