কলকাতায় গিয়ে এবার অনেকদিন পরে সিড্-এর সঙ্গে দেখা হল – প্রায় বছর পাঁচেক বাদে। সিড্ আর আমি স্কুলজীবনের বন্ধু, অবশ্য শুধুমাত্র এইটুকু বললে আমাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হবেনা। এটা কেবল ‘টিপ্ অফ দ্য আইসবার্গ’। আট বছরের পার্টনারশিপে (সিড্ ভর্তি হয়েছিল ক্লাস থ্রী তে) বেঞ্চমেট হিসেবে আমরা যেসব কীর্তিকলাপ ঘটিয়েছিলাম, সেগুলো একেবারে বাঁধিয়ে রাখার মতন ছিল। স্কুলে আমাদের জুড়িকে ‘সিড্-অরি’ বলে ডাকা হত, যেটা শুনতে অনেকটা ‘শিব-হরি’-র মতন লাগে। তফাত একটাই, তাঁরা সুর-সম্রাট, আর আমরা অসুর-বিচ্ছু!
দেখা হওয়ার পরে সিড্ আমাকে নিয়ে গেল রূপালী বালির চরে। সল্টলেক সিটিসেন্টারের উল্টোদিকের এই জায়গাটা নতুন, আগে কোনোদিন আসিনি। আসলে আমি অনেকদিন পরে এই চত্বরে এলাম। তার প্রধান কারণ হল বাড়ির এত কাছে হওয়া সত্বেও সল্টলেক জায়গাটা আমার ঠিক পোষায় না। তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, ওই “জাস্ট লাইক দ্যাট” টাইপ যাকে বলে।
অনেকদিন বাদে এলে সব জায়গাকেই কিরকম “বদলে গেছে, বদলে গেছে” বলে মনে হয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। অনেক দোকানপাট দেখলাম, তার মধ্যে বেশিরভাগই রেস্তোঁরা। এত রেস্তোঁরা আগে এখানে ছিল কি? কে জানে!
তবে রূপালী বালি জায়গাটা বেশ ভাল – পরিবেশ এবং পকেট, দুই দিক দিয়েই। সবথেকে ভাল ওখানকার সিগারেট খাওয়ার ব্যালকনিটা, বেশ ‘ফিল’ এসে যায়। সব ‘ফিল’ শব্দ দিয়ে ফিল-আপ করা যায়না, তাই কারো ইচ্ছে হলে, বা আগ্রহ হলে, পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
রূপালী বালির চরে বসে, স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে অনেক মণিমুক্তো কুড়িয়ে যখন আমরা বেরিয়ে এলাম, তখন মনমেজাজ একদম সিরাজের মতন ফুরফুরে। ফেরার পথে সিড্-কে বললাম, “কত রেস্তোঁরা হয়ে গেছে মাইরি এখানে, জায়গাটা তো চেনাই যাচ্ছে না!”
সিড্ বলল, “আরে মামা, তুমি তো এসেছিলে সেই প্রস্তরযুগে। আমরা রেগুলার আসি, আমরাই চিনতে পারিনা! তবে একটা ব্যাপার ভুল বললি”।
“কোনটা?”
“ওই যে, রেস্তোঁরা। ওই টার্মটা এখন ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। এগুলোকে এখনকার ছেলেছোকরারা বলে ‘জয়েন্ট’। আমাদের আমলে জয়েন্ট বলতে আমরা পরীক্ষা বুঝতাম, এখন জয়েন্ট মানে এইসব। রেস্তোঁরা হল গিয়ে তারামার্কা ব্যাপার, এসব ছোটোখাটো ঠেক মানেই জয়েন্ট, বুঝলি?”
না বুঝে আর উপায় কি? ‘আমাদের আমল’-ই বটে! হিসেব করে দেখলাম, প্রায় আঠারো বছর আগে স্কুল ছেড়েছি! এখনকার ছেলেছোকরাদের কাছে আমরা নিজেরাই ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছি, তায় আমাদের টার্ম।
যত্তোসব!
জয়েন্টের কথাই যখন উঠলো, তখন আর একটা জয়েন্টের কথা বলি। এটা শরৎ বসু রোড, অর্থাৎ ল্যান্সডাউনে। ল্যান্সডাউন ধরে নাকবরাবর সোজা হেঁটে গেলে প্রায় কালীঘাটের কাছাকাছি এসে এই জায়গাটার দেখা মিলবে। জায়গা না বলে ‘ভুল জায়গা’ বলাই উচিৎ অবশ্য। যাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল পুণ্যভূমি Wichita-র বিমানবন্দরের টার্মিনালে। মাঝে প্রায় দুই বছর কেটে গিয়েছে। তবে সেখানে থাকাকালীন শেষ পাঁচ বছর যে তুমুল মস্তিতে কেটেছিল, তার প্রধান হোতা ছিল এই ঋত্বিক। তাই ও আর ওর বৌয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়েই ছিলাম বলা চলে।
ঠেকটার সন্ধান ঋত্বিকই দিয়েছিল। ফোনে যখন কথা হয়েছিল, ও বলেছিল, “জায়গাটার বিশেষত্ব কি জানেন? এখানে ‘হ্যাপি আওয়ার’ চলে সাতটা অবধি, কাজেই বেশ সস্তা-সুন্দর-মজবুত ব্যাপার”। ‘আপনি’ করে বলাটা অবশ্য ঋত্বিকের বিশেষত্ব, বা বলা চলে, ওর বিভিন্ন বিশেষত্বাবলীর মধ্যে একটা। আবেগের বশে মাঝেমাঝে দু-চারটে গুলটুল ঝাড়ে বটে ছেলেটা, তবে ওর এই কথাটা ঠিক ছিল। ‘ভুল জায়গা’ নাম হলেও জায়গাটা দিব্যি লেগেছে আমার। পরিবেশ, অর্থাৎ কিনা এখনকার ভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাম্বিয়েন্স’, সেটা বেশ ভাল, আর সাতটার আগে বেরিয়ে এলে পকেটটাও বেশ সস্তার ওপর দিয়েই যাবে।
এই দুই নতুন জায়গার পাশাপাশি প্রতিবারের মতন এবারেও অভীকের সঙ্গে কফিহাউস গেছি। অভীক আর আমার বন্ধুত্বের দেড়যুগ হয়ে গেল, ভাবা যায়? আমাদের কীর্তিকলাপ নিয়ে একটা বই লেখার সময় এসেছে, ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবনাচিন্তা করতে হবে এবার।
কফিহাউসে যখন প্রথম গিয়েছিলাম, ‘ইনফিউশন’-এর দাম ছিল চার টাকা, আর পেঁয়াজির দাম ছয় টাকা। সে প্রায় পনেরো বছর আগের কথা! এই ক’বছরে সেই কালো কফি দশটাকা আর পেঁয়াজি বাইশটাকা হয়েছে, আর দাম যত বেড়েছে, কফি তত জোলো আর পেঁয়াজি তত স্বাদহীন হয়েছে। কিন্তু কফিহাউসের প্রতি আমার টানটা সেই আগের মতই আছে দেখলাম। কাপে কফি দে-বারিস্তা-কোস্তার আমলে এই ব্যাপারটা ভাল না খারাপ, কে জানে!
তবে এবারে সবচেয়ে দুঃখ পেয়েছি পার্কস্ট্রীটে গিয়ে। আমার কাছে পার্কস্ট্রীট বলতেই প্রথম যে চারটে নাম মনে আসে, সেগুলো হল মিউজিকওয়ার্ল্ড, অলিপাব, অক্সফোর্ড আর পিটারক্যাট। এদের সঙ্গে সম্পর্ক তো আর আজকের নয়, সেই কলেজজীবন থেকে। কলেজে পড়ার সময় ক্লাস কেটে অলিপাবে যেতাম, সেখানে বুড়ো সাধুর সঙ্গে খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে, স্টেক খেয়ে ঢুকতাম অক্সফোর্ডে। বইটই পড়ে, মিউজিকওয়ার্ল্ডে খানিক গানটান শুনে বাড়ি ফিরতাম। সে বড়ই সুখের সময় ছিল!
এবারে গিয়ে দেখি মিউজিকওয়ার্ল্ড হাওয়া হয়ে গেছে। কাগজে আর টিভিতে খবরটা দেখেছিলাম যদিও, কিন্তু মিউজিকওয়ার্ল্ড-বিহীন পার্কস্ট্রীটে আমি এবারই প্রথম গেলাম। মিউজিকওয়ার্ল্ডের জায়গায় একটা কেক-পেস্ট্রির দোকান, যার নাম ‘ও বোঁ প্যাঁ’, দেখে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল, ভ্যাঁ করে কাঁদার ইচ্ছেও হল। এ তো সেই ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল’-এর চেয়েও বাজে। মিউজিকওয়ার্ল্ডের গায়ে একটা জিলাটোর দোকান ছিল, সেটাও ওই বোঁপ্যাঁর ঠ্যালায় হাওয়া হয়ে গেছে।
দেখেশুনে ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগলো না, মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। ভাবলাম, যাই, একটু অলিপাবে বসি গিয়ে। আমার সঙ্গে গিন্নী ছাড়া আমাদের আরো দুজন বন্ধু ছিল। আমাদের এই ‘ডবল কাপ্ল্’ এর জুটিটাও মোক্ষম একেবারে। পুণেতে থাকাকালীন উইকএন্ডগুলো এদের সান্নিধ্যে খুব ভাল কেটেছিল আমাদের।
অলিপাবটাও কিরকম বদলে গেছে! আগে শুধু দোতলাটা এসি ছিল, এবারে দেখলাম একতলাটাও এসি করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, বরং এসি-র খরচা উশুল করবার জন্য খাদ্য এবং পানীয়র দাম বেড়ে গেছে, এবং খাবারের কোয়ালিটি একদম পড়ে গেছে। মরাঠাভূমিতে হালে গরু মারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তাই মনে অনেক আশা নিয়ে অলিপাবের স্টেক অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু দেখেই পিত্তি চটে গেল। ওরকম ঝোল-ঝোল স্টেক আমি জীবনে দেখিনি। খাওয়াব্র সময় তো আরো সরেস ব্যাপার হল। তিনবার ছুরি বদলেও স্টেক কাটতে না পেরে শেষমেশ হাত লাগাতে হয়েছিল। ওখানকার বেয়ারারাও কেমন বেয়াড়া টাইপের হয়ে গেছে। আগে কত বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করত। এবারে কিছু চাইতেই ভয় লাগছিল – যদি কামড়ে দেয়!
তবে অন্য দুটো নাম কিন্তু একেবারেই আমাকে হতাশ করেনি। পিটারক্যাটের ‘চেলো কাবাব’ আজও অসাধারণ – দর্শনে-গন্ধে-স্বাদে এখনও লা-জবাব। অক্সফোর্ডটাও দুরন্ত করেছে, আকারে-আয়তনে অনেক বড় হয়েছে। একতলা থেকে পছন্দমতো বই বেছে নিয়ে দোতলায় আরামদায়ক সোফায় এলিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়লেও কেউ বিরক্ত করবে না, আর বই পড়তে পড়তে যদি তেষ্টা পায়, তার জন্য দোতলাতেই ‘চায় বার’ আছে, যেখানে চা-কফি-স্ন্যাক্স সবই পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে আমার জন্য একদম আদর্শ পরিবেশ যাকে বলে!
বিরতির আগে ট্যাক্সির অনেক গুণগান করেছিলাম। কিন্তু সেদিন অলিপাব থেকে ফেরার পথে ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে বেশ নাকাল হতে হয়েছিল। ৪০০ টাকা থেকে আরম্ভ করে নামতে নামতে অবশেষে ‘মিটারের ৩০ টাকা বেশি’ হিসেবে চালকমশাই রাজি হয়েছিলেন। বুঝলাম, দরাদরি ব্যাপারটা আজকাল ফুটের মাল কেনার মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই, ট্যাক্সি চড়তে গেলেও এই আর্টটা আজকাল কাজে লাগছে।
এবারে একটা নতুন জিনিস চড়লাম। হাওড়া অঞ্চলের গলিগালাতে আজকাল সাইকেল রিক্সার পাশাপাশি টোটোর খুব চল হয়েছে। ব্যাটারিচালিত এই গাড়িগুলো আমার বেশ পছন্দ হয়েছে – আওয়াজ কম, দূষণ কম আর সবচেয়ে যেটা বড় ব্যাপার, আগে সাইকেল রিক্সায় যুগলে চড়লে রিক্সাওয়ালাকে দেখে যেরকম কষ্ট লাগতো, মনে হত যে কোনো মুহুর্তে বেচারার প্রাণটা বুঝি বেরিয়ে যাবে, টোটো চড়াকালীন সেরকম কোনো অনুতাপ হয়নি। এটা কি কম বড় পাওনা?
এইসব করেটরে দুই সপ্তাহের ছুটিটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, টেরই পেলাম না। ফেরার সময় কলকাতা বিমানবন্দরের ঘ্যামচ্যাক নতুন টার্মিনালে বসে মোমো খেতে খেতে না চাইতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল – অফিস নামক জঙ্গল আর বাঘ-ভাল্লুকের কথা ভেবে।
ছুটিগুলো যে কেন আরো লম্বা হয়না!
(খতম)
পুনশ্চঃ একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আগে বিদ্যাসাগর সেতুর রেলিংটাই শুধু নীল-সাদা ছিল, এবারে দেখলাম বডিটা পুরো সাদা করে দিয়ে তাতে নীল নীল বরফি আঁকা হয়েছে, দেখে রূপমের ‘নীল রঙ ভীষণ প্রিয়’ গানটার কথা মনে পড়ে গেল।
Oye……amar songe j dekha holo 10 bochhor por…..seta kothaye galo?
chinbo ki kore? tor fb pic r asol cheharar modheye lal-nil er farak thakle? 😉
ধুস, তুমি তো আমাকে দেখে চিনতেই পারলে না! 😦
তাছাড়া সব কথা অত লিখতে নেই, কিছু কিছু কথা মনে রেখে দেওয়া ভাল। 🙂
লাল-নীল ফারাক! কথাটা বেড়ে বলেছ! 😀
আপনার লেখার হাতটি খাশা। আজ সকাল থেকে বসে আপনার সব কটি লেখা মন দিয়ে পড়ে ফেললাম। আপনি ছ-মাস পুর্তিতে লিখেছেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি সারা দিন অফিসে বসে ব্লগ লেখেন, আমার ক্ষেত্রে কথাটা আরো একটু বেশী সত্যি। আমি সারা দিন ব্লগ পড়ি মাঝে মাঝে। অফিসে বসেই। বিশেষ করে আপনার মত এমন সরেস বস্তু পেলে। মন্তব্য এই লেখায় করছি বটে, কিন্তু করছি পুরো ব্লগের জন্যেই। চালিয়ে যান। আপনার কলম (কিবোর্ড) অক্ষয় হোক।
আহা সোমনাথবাবু, বড্ড ভাল লাগলো আপনার কমেন্ট পেয়ে। 🙂 মাঝে মাঝে এরকম কমেন্ট শুনলে মনে বেশ বল-ভরসা আসে।
অফিসে ব্লগ পড়তে আমারও ব্যাপক লাগে, তবে দুঃখের কথা এই যে, এখন বিশেষ সুযোগ পাইনা।
আমার ও একখানা ব্লগ আছে বটে। পড়তে চাইলে। কিন্তু সে বস্তু এত সরেস নয়। তার ওপরে আম হাড় আলসে লোক। তাই কালে ভদ্রে দু এক পিস।
পড়তে হবে তাহলে, শীঘ্রই পড়ে নিয়ে মতামত জাহির করব। 🙂
dwitiyaadhyay.blogspot.in এইটা
kolkattar kaorcha ta bhalo i laglo. tobe e kotha ashikaar kaar jagya nei je amra bake dated hoye porechchi. ekon aar juger sange pa mela te besh kosto hoy. hobe Toto t kore to to kore ghorar saubhagya hoy ni. ebare boro chuti niye eso kolkatay .
যা বলেছিস ভাই, ব্যাক-ডেটেড ই বটে!
টোটো গাড়ি খুব মজার জিনিস, তবে আমাদের চত্বরে চলে কিনা জানিনা। 🙂
এবারের ছুটিটা বড়ই ছিল, এর চেয়ে বড় ছুটি চাইলে একেবারে ছুটি দিয়ে দেবে! 😀
As usual oshadharon, kichu durlobh bhasha proyog kore ei notun kolkata ke chenano r proyash ta ke sadhubad na janiye parlam na… Oi sondhey ta darun ketechichilo…. arekbaar dhonyobad 🙂
তোর কমেন্টের জন্য তোকেও অনেক ধন্যবাদ জানাই। 🙂
সেদিনের সন্ধ্যাটার জন্য ধন্যবাদটা নিলাম না অবশ্য।