মার্কিনমুলুকে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার ‘কোর গ্রুপ’টা ছিল পাঁচজনের – গবা, মাসি, বদ্দা আর আমি ছাড়া আমাদের পঞ্চম সদস্যটি ছিল হিলু। আমার সঙ্গে হিলুর আলাপ ইউনিভার্সিটিতে, আর সেই আলাপটা গভীর হয়েছিল বিদেশে গিয়ে। হিলু বেশ মজাদার ছেলে, পুরনো বাংলা-হিন্দি-ইংরেজী গান এবং সিনেমার ভক্ত, মাঝেমধ্যে ক্লাসিকাল সঙ্গীতও শুনে থাকে, তাছাড়া সাহিত্য, কনিয়াক এবং সিঙ্গল মল্টের প্রতিও বেশ গভীর অনুরাগ। এতগুলো ভালভাল গুণ থাকলে কি আর বন্ধুত্ব না হয়ে পারে?
বদ্দা যেরকম আমাদের ড্রাইভার, হিলু তেমনি হচ্ছে আমাদের ন্যাভিগেটর। আমরা জিপিএস ব্যবহার করতাম না, কেননা যন্ত্র আমাদের হাত ধরে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, সেটাতে ছিল আমাদের ঘোর আপত্তি। তাই আমাদের সম্বল ছিল ম্যাপকোয়েষ্ট কিংবা গুগ্ল্ ম্যাপের প্রিন্ট-আউট। তাতে মুশকিল যে হতনা মাঝেমাঝে, তা নয়। একবার যেমন ম্যাপকোয়েষ্টের নির্দেশে আমরা একটা ওয়ান-ওয়েতে ঢুকে পড়েছিলাম, আর ফেডেক্স-এর গাড়ী এসে আমাদের রেন্টেড মালিবু-টাকে একটা আলতো চুমু দিয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক, প্যাসেঞ্জার সিটে বসে ডানদিকে যেতে হবে না বাঁদিকে, বা কতখানি গিয়ে হাইওয়ে থেকে কত নম্বর এক্সিটটা নিতে হবে, এইসব কিছু হিলু বদ্দাকে বলে দিত। তবে হিলু্র ন্যাভিগেটর হওয়াটা যতটা না ‘বাই চয়েস’, তার থেকে বেশি ‘বাই কম্পালশন’, কেননা আর অন্য কোনো অপশন ছিলনা। আমার ডান-বাঁ জ্ঞান অত্যন্ত বাজে, হামেশাই বদ্দাকে ভুল পথে চালিত করতাম। মাসি আবার ছিল লেটলতিফ, টার্ন নেওয়ার একশো মিটার আগে বলে বসত, “ঘোঁতু, বাঁদিকে টার্ন নিতে হবে”, বদ্দা তখন মনের আনন্দে ডানদিক ঘেঁষে চলেছে, আর বাঁদিকে যেতে গেলে আরো তিনটে লেন পেরোতে হবে! গবাটা গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ত, আর মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বেমক্কা বলে বসত, “আগেরবার (মানে যখন জেগে ছিল আর কি!) এক্সিটগুলো বাড়ছিল, এখন কমছে কেন?” মালকে কে বোঝাবে যে এর মধ্যে হাইওয়ে বদলে গেছে?
অতএব হিলুই ভরসা, আর অভ্যাস এবং অধ্যবসায় দিয়ে হিলু এই ব্যাপারটাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। পরের দিকে তো ওর প্রিন্ট-আউটও লাগতো না, রোড অ্যাটলাস বইটা দিয়েই কাজ চালিয়ে দিত।
ক্যালিফোর্নিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম সেবার। কোথাও একটা থেকে ফেরার পথে অ্যাটলাস দেখতে দেখতে হিলু বলে উঠল, “এখান থেকে কিছু মাইল দূরে একটা বিচ আছে, যাবি নাকি?” আমরা তিনজন তো সবসময়েই রাজী, তাই আমরা বদ্দার দিকে তাকালাম – হাজার হোক, ও-ই তো চালক, ওরও তো খাটনী হয়! কিন্তু এইসব ব্যাপারে বদ্দার বিশাল এন্থু, তাই সানন্দে রাজী হয়ে গেল।
তারপর শুরু হয়েছিল ড্রাইভার-ন্যাভিগেটরের যুগলবন্দী। প্রায় ঘন্টাদুয়েক কেটে গেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা হব হব, কিন্তু আমরা বিচের দেখা পেলাম না। এর মধ্যে বারদুয়েক বদ্দা হিলুকে প্রশ্ন করেছে, “হিলু, বিচটা সত্যিই আছে তো?”, হিলু তুমুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নেড়েছে আর আমরা তিনজনে পেছনে বসে তুমুল খিল্লি নিচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ হিলু বেদবাক্যের মতন ঘোষণা করল – সামনের এক্সিটটা নিয়ে বাঁদিকে কিছুদূর এগোলেই বিচ।
কিন্তু আমাদের কপালে সেদিন বিচ ছিলনা। অকুস্থলে পৌঁছে দেখি, ওটা একটা মার্কেটপ্লেস। আমি আর লোভ সামলাতে না পেরে বলে উঠলাম, “জিও! বিচ পাইনি তো কি হয়েছে, বিচ বাজার তো পাওয়া গেল!”
আমার এই কথায় হিলু এতটাই দুঃখ পেয়েছিল যে সেদিন ফেরার সময় ন্যাভিগেটও করেনি।
অন্য একটা বিষয়েও হিলু ছিল এক্সপার্ট, সেটা হচ্ছে হাসিহাসি মুখে লোকের পিত্তি চটানো (পাতি বাংলায় যাকে ঝাঁট জ্বালানো বলে)। একবার ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে তুমুল গজল্লা চলছিল। এমনিতেই আমরা যে বেঞ্চে বসতাম, সেখানে অন্য কেউ, বিশেষ করে বয়স্করা, বসার সাহস করত না। সেদিন অবশ্য আমাদের উল্টোদিকে দুজন বসেছিলেন এবং আমাদের গজল্লায় অতিষ্ঠ হয়ে একজন অন্যজনকে বললেন, “হঃ! আজকালকার ছেলেপুলেদের মুখের ভাষা দেখেছেন? কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে এরা কি একটু ভদ্র হতে পারেনা?”
অন্য লোকটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। হিলু অমনি বলে উঠলো, “বুঝলি গবা, ভদ্র জিনিসটা না, হওয়া যায়না, ওটা হয়ে জন্মাতে হয়!”
এই কথা শুনে, বলাই বাহুল্য, তাঁরা পত্রপাঠ উঠে চলে গিয়েছিলেন।
হিলুর এইরকম ওয়ান লাইনার আমাদের দিকে এলে আমরাও হেব্বি চটে যেতাম, তবে ওর কথায় সবচেয়ে বেশি চটেছিল টাগলা।
টাগলার আসল নাম স্বাভাবিকভাবেই টাকলা (কারণটা সহজেই অনুমেয়), কিন্তু ওকে টাগলা বলেই ডাকি আমরা – ও ‘ক’ কে ‘গ’ বলে, মানে নুচি-নেবু-ন্যাগড়া-নারগেল গোত্রভুক্ত আর কি। টাগলা মফ-র মাল, তাই ট্রেনেই যাতায়াত করত ইউনিভার্সিটিতে। একদিন কি কারণে যেন টাগলা আসেনি, পরেরদিন ক্লাসে ঢুকতেই হিলু ওকে হাসিহাসি মুখে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিরে ব্যাটা, কাল এলিনা কেন? রেললাইনে জল জমে ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?”
বেচারা টাগলা সবেমাত্র তখন অফিসটাইমের ভীড় ট্রেন ঠেলে ঘেমেনেয়ে কোনোমতে ক্লাসে এসে ব্যাগটা রেখেছে, হিলুর ওই কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল শুধু নয়, স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে গবার লূপটাও চালিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে টাগলা কামাই করলেই হল, বৃষ্টি হোক না হোক, আমরা ওকে ওটা বলেই ক্ষ্যাপাতাম!
এমনিতে ছেলেটা ভাল – হাল্কার ওপর তিলেখচ্চর, বন্ধুবৎসল, তুমুল আড্ডাবাজ, তেলেভাজা আর জেমস বন্ডের বিশাল ভক্ত (এমনকি ইমেইল আইডিতেও বন্ডের নাম ঢুকিয়েছে নিজের সঙ্গে), কিশোরকুমারকে গুরু বলে মানে, গানটাও মন্দ গায়না, টোয়েন্টিনাইন খেলায় রঙ না দেখিয়ে গোলাম দিয়ে ট্রাম্প করে, এক্সোটিক ডাল বানানোর চক্করে তাতে গরম মশলা দিয়ে ফেলে আর খাঁটি বাঙালি হয়েও পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ইলিশমাছের ঝাল রান্না করতে পারে।
ওঃ হ্যাঁ, টাগলা কাটাকুটিতেও হেব্বি এক্সপার্ট!
ওর এই গুণটা ওর নিজের থেকেও বেশি কাজে লেগেছে আমাদের। ট্রিপে গেলে গবা যেমন ছিল আমাদের রাঁধুনী, টাগলা তেমনি ছিল জোগালে – পেঁয়াজ-রসুন-টম্যাটো-আনাজ থেকে মুরগী অবধি হেলায় নামিয়ে দিত, আর প্রিসিশনটাও ছিল দেখার মতন! ফাইন চপিং-এ টাগলা এমনই এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিল যে মার্কিনমুলুকের যে শহরে ও থাকতো, সেখানকার বং কমিউনিটি থেকেও ওকে মাঝেমধ্যে ডেকে পাঠানো হত এই কাজের জন্য।
বন্ধুদের মাঝে পড়লে টাগলা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে যায়, যার ফলে ওর লঘু-গুরু জ্ঞানটাও লোপ পায়। একবার যেমন একটা ট্রিপে সবাই জড়ো হয়েছে, লিভিংরুমে প্রচুর হল্লাহাটি-ঢুকুঢুকু-তাসপেটানো চলছে। হঠাৎ টাগলা সবাইকে বলল, “এই এই, চুপ চুপ, আমি এখন বাড়িতে একটা ফোন করে নিই, তোরা বেশি খিস্তিখাস্তা করিস না”। বাড়িতে ফোন করার সময় আমরা সবাই নিমেষের মধ্যে রাখাল থেকে গোপাল হয়ে যেতাম, আর অন্য রাখালদেরও সানন্দে সাহায্য করতাম। যাই হোক, টাগলা পাশের ঘরে গেল ফোন করতে, আমরাও আমাদের ফূর্তির ভল্যুমটা কিঞ্চিৎ কমালাম।
ফোন কানে নিয়ে মাঝেমাঝেই টাগলা লিভিংরুমে উঁকি দিচ্ছিল আমরা কি করছি-বলছি সেটা বোঝার জন্য, যেটা না করলেও ওর চলত। যাই হোক, তখন গ্লাস রিফিল করতে উঠেছিলাম আমি, আর ঈষৎ টলটলায়মান অবস্থায় চলতে গিয়ে মাটিতে রাখা ম্যাট্রেসে হোঁচট খেয়ে ওটার ওপরেই আছড়ে পড়লাম। বাকিদের খুকখুক হাসি, চাপাস্বরের ‘কি তালকানা মাল মাইরি’, ‘আর খাস না’ ইত্যাদির মাঝে হঠাৎ একটা জোরগলার কথা শুনলাম – অ্যাই বান…, দেখে সলতে পারো না?
তাকিয়ে দেখি টাগলা ফোন কানে নিয়ে লিভিংরুমে আবার এসেছে ফিরিয়া, আর কথাটা ওরই, আর কথাটা শেষ হওয়ার পরে খানিক নীরবতার পরেই একটা গম্ভীর গলা ভেসে এসেছিল ফোনের ওপার থেকে – বন্ধুদের সাথে মজা করছ খুব ভাল কথা, কিন্তু আর একটু সংযত হলে হত না?
আবেগের বশেই হোক আর কানের চাপেই হোক, টাগলার ফোনের স্পিকারটা অন্ হয়ে গিয়েছিল, আর তার চেয়েও অবাক কান্ড, মালটা ভুলেই গিয়েছিল ও ওর বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে!
তবে আমার বন্ধুবৃত্তের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্রটির নাম গাঁজা। ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারে, কলেজ লাইব্রেরির সামনে। গাঁজা তখন ছিল নিতান্তই ভালমানুষ গোছের – স্টুডিয়াস আর নেশাভাং থেকে শতহস্ত দূরে। ক্লাসে ইন্ট্রো দেওয়ার সময় এমন একখানা ভাষণ ঝেড়েছিল যে ব্যোমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু কলেজের তিন বছরে ব্যাটার এমন পরিবর্তন ঘটেছিল যে বলার নয়। যে ছেলে প্রথমদিকে আমাদের জন্য সিগারেট কিনতে গিয়ে দোকানদারকে বলেছিল, “দাদা, চারটে ভাল দেখে সিগারেট দিন তো!”, তার রূপান্তরটা বোঝানোর জন্য একটা ছোট্ট উদাহরণই যথেষ্ট।
নিউ ইয়ার উইশ করতে গিয়ে প্রথম বছর শুনেছিলাম গাঁজা ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন সবেমাত্র বারোটা বেজেছে, এর মধ্যেই ঘুম?
দ্বিতীয় বছর সোয়া বারোটা নাগাদ ফোন করেছিলাম, গাঁজা ফোন তুলেছিল, শুনলাম ছেলে এগারোটার পরে বাড়ি ফিরেছে, খানিক গল্পগুজবও হয়েছিল।
তৃতীয় বছর রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ফোন করে বেশ খারাপ লেগেছিল, কেননা কাকীমা, মানে ওর মা, ফোনটা ধরেছিলেন, অত রাতে তাঁকে ডিস্টার্ব করার জন্য ‘সরি’ বলব ভাবছি, এমন সময় তাঁর জবাবটা শুনে পুরো হুব্বা হয়ে গিয়েছিলাম।
গাঁজা রাত আটটায় বেড়িয়ে গেছে, এবং তখনও বাড়ি ফেরে নাই!
(চলবে)
নামগুলো ব্যাপক… এবং বেশ একটা বৈঠকি মেজাজের লেখা পাওয়া গেল…দিব্যি একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম… 😀
থ্যাঙ্কু এল্ডার সিস্টার। 🙂
হিলু er one liner ta ekhub bhalo laglo . asha kori গবা, মাসি, বদ্দা ,টাগলা , গাঁজা er sange samproko atut achche . Naam gulo banglay lkhlam karan nio le naam gulo er prati abichchar kora hoto . Satyi erkom bandhu thakle onek tai bahlo lage .
সম্পর্ক অটুট আছে তো নিশ্চয়ই। 🙂