(পর্ব-১)
(পর্ব-২)
গাঁজা এমনিতে দেখতে শান্তশিষ্ট হলেও, মালটার টেম্পারটা খুবই, যাকে বলে ভোলাটাইল – ছেলে যখনতখন যেখানেসেখানে রেগে যায় হঠাৎ করে। একবার যেমন কলেজের বাইরে আমরা কয়েকজন আলুকাবলি খাচ্ছিলাম, আমাদের সঙ্গে গাঁজাও ছিল। তখনও ফার্ষ্ট ইয়ার রান-আপ নিচ্ছে, তাই গাঁজাকে আমরা কেউই সম্যক চিনতাম না। যাই হোক, আলুকাবলিওয়ালা আমাদের সবার হাতেহাতে শালপাতার বাটি ধরিয়ে দেওয়ার পরে হঠাৎ করে গাঁজা জিনিসটার দাম জিজ্ঞেস করল। এতদিন পরে টাকার অঙ্কটা আর খেয়াল নেই, তবে যেটা খেয়াল আছে, সেটা হচ্ছে যে দাম শুনে গাঁজা মোটেই খুশি হয়নি। শুধু তাই নয়, “এত টাকা! এইটুকু আলুকাবলির দাম এত টাকা!!” বলে সটান শালপাতার বাটিটা দোকানদারের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল, আর সেটা ফ্লাইং ডিস্কের মতন সাঁইসাঁই করে ঘুরতে ঘুরতে, অল্পের জন্য দোকানদারের কানটা ফস্কে, উল্টোদিকের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল। দোকানদার তার কেরিয়ারে এরকম খদ্দের মনে হয় আর দেখেনি, তাই সে অনেকক্ষণ হুব্বা হয়ে গাঁজার দিকে তাকিয়েছিল। গাঁজার এই রাগের ফলে লাভবান হয়েছিল রাস্তার কুকুরগুলো, চেটেপুটে আলুকাবলি সাঁটিয়েছিল তারা।
এরপর থেকে, বলাই বাহুল্য, গাঁজা বন্ধুমহলে বেশ ফেমাস হয়ে যায় আর আমার সঙ্গে ওর সখ্যতাটাও বেশ ডালপালা মেলতে থাকে। সিনেমা-সাহিত্য-সঙ্গীত, তিনটেতেই ওর বেশ ভাল আগ্রহ এবং ফান্ডা ছিল, তাছাড়া আমরা দুজন ছিলাম, যাকে বলে ‘পার্টনার্স ইন ক্রাইম’। ঢাকুরিয়া লেক-এ বাবার প্রসাদ নেওয়া, ক্লাস কেটে সিনেমা দেখা, অলিপাবে বুড়ো সাধুর সঙ্গে সময় কাটানো – এই সবকিছুই আমরা একসঙ্গে করেছিলাম। মাঝেমাঝে যেটুকু পড়াশোনা করেছি, সেটুকুও একসঙ্গেই করেছি, কেননা গাঁজা আর আমি লেকটাউনে পড়তে যেতাম, যেখানে পড়া কম আর টোয়েন্টিনাইন খেলা বেশি হত! স্রেফ আমার সঙ্গে আড্ডা দেবে বলে গাঁজা দক্ষিণ কলকাতা থেকে লেকটাউনে পড়তে আসত। সাড়ে আটটা-নটায় পড়া শেষ করে লেকটাউন থেকে বাস ধরে আমরা উল্টোডাঙ্গা ফিরতাম, বাসস্ট্যান্ডে ঘন্টাখানেক আড্ডা হত, তারপর রাত সাড়ে দশটার এস-নাইন্টিন (ওটাই ছিল লাস্ট) ধরে ও বাড়ি ফিরে যেত।
আমাদের ডিপার্টমেন্টের দোর্দন্ডপ্রতাপ একজন স্যারকে গাঁজা একটা কথা বলেছিল, যেটা আমাদের বন্ধুমহলে ‘কাল্ট স্ট্যাটাস’ পেয়ে গেছে। সেই স্যার দুটো বিষয়ে প্রতিভাবান ছিলেন – পড়ানো, এবং কেত। ওরকম খর্বকায় একজন মানুষ – চাইলে ফুটপাথে বসেও পা দোলাতে পারেন – যে ওরকম কেৎবাজ হতে পারেন, সেটা তাঁকে না দেখলে বোঝা দুষ্কর। তবে ভদ্রলোক পড়াতেন খুব ভাল। একবার আমরা দুজনে বুকভরে বাবার প্রসাদ টেনে ক্লাসে এসে বসেছিলাম। স্যার টু-ডিমেনশনের জিনিসপাতি বোঝাচ্ছিলেন, আর আমরা এন-এথ্ ডিমেনশনে ছিলাম। তো যাই হোক, কি একটা কথায় গোটা ক্লাস হেসে উঠেছিল, আর সেইসঙ্গে স্যারও। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ গাঁজা সটান উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “হাসিখানা যা দিলেন না স্যার! এরকম হাসি লাস্ট দিয়েছিল মার্লোন ব্র্যান্ডো, তারপর উত্তমকুমার, আর তারপরেই আপনি, ফাটাফাটি!”
গোটা ক্লাস চুপ করে গিয়েছিল, আর ঘটনার আকস্মিকতায় স্যারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্পিকটিনট হয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাটা এরপর আর বেশিদূর গড়ায়নি, তবে গাঁজা এরফলে অন্য লেভেলে উঠে গিয়েছিল।
এখনও যখন ফোনে আড্ডা হয়, আমরা এটা নিয়ে গবেষণা করি। এত লোক থাকতে হঠাৎ মার্লোন ব্র্যান্ডো আর উত্তমকুমার কেন, এটা একটা গবেষণার বিষয় নয় কি? কিন্তু অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পরেও এখনও আমরা এর উত্তর খুঁজে পাইনি।
বয়েস বাড়ার সাথে সাথে গাঁজার টেম্পার এখন অনেক কমেছে, ওর নিজের কথায়, “শালা আমি হলাম হরিপদ কেরানী, হরিপদ কেরানীর এত রাগ ভাল নয়!”
কি সব ফান্ডা!
বন্ধুদের গল্প করতে বসে আপাতত যার কথা বলে শেষ করব, তার নাম ন্যাড়া। এগারো ক্লাসে অঙ্কের কোচিং ক্লাসে ওর সঙ্গে আলাপ – তখন অবশ্য ওর মাথায় চুল ছিল। হঠাৎ ওর মাথার পোকাগুলো নড়ে উঠেছিল, যেটা সামলানোর জন্যে ও ন্যাড়া হয়ে যায়। সেই থেকেই, বলা বাহুল্য, ওর এই নামের সূত্রপাত।
ন্যাড়ার মধ্যে একটা ভীষণ ভাল ব্যাপার আছে, যে কোনো বিষয়ে ওকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। বেশ ঠান্ডামাথার ছেলে, আর শত চেষ্টাতেও ওকে রাগানোটা চাপের। ইদানিং অবশ্য ওকে রাগানোর একটা উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি। ব্যাপারটা খুবই সহজ। মুম্বইতে কিলো দরের একটা বইমেলা হয় বছরে দুবার, যেখানে নিজের পছন্দমত এক কিলো বই মাত্র একশো টাকায় পাওয়া যায়। ওই মেলা থেকে ঘুরে এসে কি কি বই কিনলাম, তার একটা লিষ্ট বানিয়ে ওকে মেইল করে দিই, ব্যস, তারপরেই আমার ফেসবুকের মেসেজবক্স-এ খিস্তির বন্যা বয়ে যায়!
ন্যাড়ার বই পড়ার বাতিকটা জম্পেশ, আর ওর নিজের বইয়ের কালেকশনটাও বেশ ভাল – বটতলা থেকে কাফকা, সবই মিলবে, আর বই পড়তে দেওয়ার ব্যাপারেও ও খুবই উদার। কিন্তু সেটা ঝেড়ে দিতে চাইলেই মুশকিল। কতবার কতরকমভাবে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আজ অবধি সফল হইনি। প্রতিবারই আমার থেকে বইটা ফেরত নিয়ে ন্যাড়া দাঁত কেলিয়ে বলেছে, “কতবার না তোকে বলেছি, কাক হয়ে কাকের মাংস খেতে নেই?”
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি বই চুরি করি, আর তাতে আমার কোনো অনুতাপ জাগে না।
কলকাতার রাস্তাঘাট ন্যাড়া ব্যাপক চেনে, আর শহরটার প্রতি ওর একটা অকৃত্রিম ভালবাসাও আছে। ওর সঙ্গে ঘুরে ঘুরেই কলেজস্ট্রীট আর কফিহাউসের প্রতি আমার টানটা আরো তীব্র হয়েছে। ডেকার্স লেন-এর সুস্বাদু খাবারদাবার আর পার্কস্ট্রীটের ফুটপাথের পঁয়ত্রিশ টাকার(আমাদের সময়ে অতই ছিল, এখন নিশ্চয়ই দাম বেড়ে গেছে) ইংরেজী বইয়ের সন্ধান ন্যাড়াই আমাকে দিয়েছিল। ওর সঙ্গে টো-টো করেই আমি খানিকটা কলকাতা চিনেছি, সেটাও ঠিক।
ন্যাড়া মাঝেসাঝে নানা বিষয়ে আর্টিক্ল লিখে থাকে, সেগুলো পড়তে খুব ভাল লাগে। ইদানিং দেখছি কাব্যচর্চায় মন দিয়েছে, বেশ সোজাসাপ্টা ভাষাতেই লেখে, তাই আমিও একটু-আধটু বুঝতে পারি। কতদিন অবশ্য এটা নিয়ে থাকবে, সেটা জানিনা। ফটো তোলার শখও আছে ছোঁড়ার, বেশ অভিনব বিষয়টিষয় নিয়ে ছবিছাবা তোলে। আমার ক্যামেরার জ্ঞান শূন্য, তবে মনে হয় ওর তোলা ছবিগুলো বেশ উচ্চমানেরই।
কবিতা, সাহিত্য এবং ছবিতোলা ছাড়া ন্যাড়া সিনেমার পোকাও বটে। বাংলা এবং হিন্দি সিনেমা ছাড়া ফেলিনি-বার্তোলুচি-গোদার-ত্রুফো-কুব্রিক-কুরোসাওয়া ইত্যাদি আঁতেল পরিচালকদের আঁতেলমার্কা সিনেমাগুলোও ও দেখে, আর আশ্চর্যের ব্যাপার, সেগুলো বোঝেও! আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ওর মধ্যেই আঁতেল হওয়ার যাবতীয় মশলা মজুদ আছে। কিন্তু তবুও যে ও আঁতেল হতে পারেনি, তার কারণ, ফেলিনি-বার্তোলুচি ছাড়া ও রাজা চন্দ-ডেভিড ধাওয়ান-কান্তি শাহও দেখে। কোনো একটা ইয়ে, মানে বাছবিচার নেই মালটার, একটা অঙ্কুরসম আঁতেলচারাকে ও মহীরূহে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে না।
ভাগ্যিস!
নইলে কি আর ও আমার এত ভাল বন্ধু হতে পারত?
Ke bole smriti sotottai dekher. erokom smiriti je kono somoy mukhe hasi ene debe. বন্ধুদের গল্প ero pele bhalo lagbe.
একদম ঠিক বলেছিস। 🙂
koto sundor kore kotha gulo bolli, darun laglo
অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। 🙂