আজ থেকে একমাস আগেও আমি দশরথ মাঝির নাম জানতাম না। একদিন ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে ‘মাঞ্ঝি’ সিনেমার ট্রেলারটা চোখে পড়ে গিয়েছিল, আর নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি আছে বলে ট্রেলারটা দেখেও নিয়েছিলাম। যদিও সেখানে বলা ছিল যে ফিল্মটা সত্যি ঘটনার ওপর তৈরী হয়েছে, তবুও ঠিক মানতে পারিনি – কত সিনেমাতেই তো এই কথাটা লেখা থাকে, কিন্তু আদৌ সেটা সত্যি হয় কি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো প্রযোজক-পরিচালকেরা ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ যেটা তৈরী করেন, সেটার সঙ্গে আসল ঘটনার বিশেষ মিল থাকেনা। তবে এক্ষেত্রে পরিচালকের নাম কেতন মেহতা, যিনি বায়োপিক খুব একটা খারাপ বানাননা (মঙ্গল পান্ডের ওপর সেই অমঙ্গলে ফিল্মটা ছাড়া, যেখানে আমির খানের ওই গোঁফটা ছাড়া বাকি সবই নকল ছিল)। কেতনবাবুর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি, ‘রঙ রসিয়া’ আমার বেশ ভাল লেগেছিল, তাই ‘মাঞ্ঝি’ নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যেত।
তবে আমার মানতে না পারার কারণটা অন্য। একটা গেঁয়ো লোক স্রেফ হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে একটা পাহাড়কে কাবু করে তার বুক চিরে রাস্তা বানিয়ে ফেলল – ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য নয়? বাইশ বছর ধরে এই একটামাত্র কাজই নাকি সে করেছে, অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই। কতখানি মনের জোর থাকলে এটা করা সম্ভব?
‘মাঞ্ঝি’ মুক্তির দিন যত কাছে এগিয়ে আসছিল, কাগজে দশরথকে নিয়ে লেখালেখি ততই বেড়ে যাচ্ছিল। সেগুলো আমি বেশ মন দিয়ে পড়তাম। গয়া জেলার গেলৌর গ্রামের বাসিন্দা ছিল দশরথ, যে গ্রামে আর কিছু থাক-না থাক, একটা বিশাল পাহাড় ছিল। সেই পাহাড়ের জন্যই গ্রামবাসীদের প্রায় সত্তর কিলোমিটার ঘুরপথে হাসপাতালে যেতে হত। এই বিষয়টাকে সবাই ‘কপালের ফের’ বলেই মেনে নিয়েছিল, এমনকি দশরথও। কিন্তু যেদিন দশরথের বৌ ফাগুনী দেবী একটা দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পথেই প্রাণ হারায়, সেদিন দশরথ রুখে ওঠে। যে পাহাড় তার জীবন নষ্ট করেছে, সেও তাকে উচিৎ শিক্ষা দেবে, পাহাড় কেটে তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা বানাবে সে, বানাবেই।
এরকম একটা অসম্ভব এবং অবাস্তব কথা শুনলে সাধারণ মানুষের মনে একটাই রি-অ্যাকশন হয়, “আহা রে, বৌ মরে গিয়ে বরটা বোধহয় পাগলই হয়ে গেল”। গেলৌরের গ্রামবাসীরাও দশরথকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবেনি। কেউ কেউ ভেবেছে, এই বিচিত্র খেয়াল সাময়িক মাত্র, ঘোর কেটে গেলেই দশরথ রণে ভঙ্গ দেবে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু দশরথ নিজে তো জানত সে কি করতে চায়। বাইশ বছর ধরে, একটু একটু করে, সামান্য হাতুড়ি আর বাটালি নিয়ে, সে তৈরি করে চলে তার তাজমহল, তার ‘ফাগুনিয়া’-র জন্য।
১৯৬০ সালে আরম্ভ করেছিল এই একক মহাযজ্ঞ, যেটা শেষ হয় ১৯৮২ সালে। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বিশাল কর্মকান্ডের পরেও – প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা কমিয়ে ফেলেছিল দশরথ পাহাড় কেটে – দশরথের জীবন বদলায়নি বিশেষ। ‘মাউন্টেন ম্যান’ খেতাব, রাস্তার নাম ‘দশরথ মাঝি পথ’ আর ২০০৭ সালে মৃত্যুর পরে বিহার রাজ্য সরকারের দেওয়া একটা রাষ্ট্র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া – ব্যস, এইটুকুই যা পাওনা হয়েছিল লোকটার, সঙ্গে কিছু শুকনো মৌখিক প্রশংসা।
দশরথ মাঝির জীবনের এইসব ঘটনাগুলো আমি কাগজ পড়েই জেনেছিলাম, আর জানার পরে প্রচুর অবাক হয়েছিলাম। মানুষের পক্ষে তাহলে সবই সম্ভব? “অসম্ভব বলে কিছু নেই” বাক্যটা নেহাতই কথার কথা নয় তাহলে?

সিনেমা দেখার আগেই যদি তার গল্প জানা হয়ে যায়, তাহলে আর অতটা ইন্টারেষ্ট থাকেনা। তা সত্বেও আমি সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম দুটো কারণে – এক, কেতন মেহতা, কিভাবে ভদ্রলোক দশরথের জীবনকাহিনী বলেছেন, আর দুই, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, কিভাবে তিনি দশরথকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
যা দেখলাম, তাতে মন্দ লাগল না। কেতনবাবু সিনেমাটায় কিছু নতুন জিনিস আমদানি করেছেন। গ্রামের অত্যাচারী মুখিয়া আর তার ছেলে, জাতপাত এবং ছোঁয়াছুঁয়ি, নকশাল আমল, জরুরী অবস্থা, ইন্দিরা গান্ধী, সরকারী গ্রান্ট ঝেঁপে দেওয়া দুনম্বরী বিডিও অফিসার, সৎ এবং উপকারী সাংবাদিক – সবকিছুই হাল্কা করে ছুঁয়ে গেছেন পরিচালক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য দশরথের বিহার থেকে পায়ে হেঁটে দিল্লী গমনটাও বাদ দেননি। জানিনা এই ঘটনাটা সত্যি কিনা, তবে যে লোক পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে পারে, তার পক্ষে সবই সম্ভব।
ফাগুনিয়ার সঙ্গে দশরথের দৃশ্যগুলো বেশ উপভোগ্য, বিশেষ করে ফাগুনিয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ এবং বাড়ি থেকে তুলে আনার সিকোয়েন্সদুটো। ওদের মধ্যে প্রেম, খুনসুটি, কথোপকথনগুলোও বেশ মজাদার। সন্দেশ শান্ডিল্যর সুরে গানগুলোও বেশ ভাল লাগে।
ফাগুনিয়ার ভূমিকায় রাধিকা আপ্টেকে ভাল লাগে। সেই সময়কার গ্রাম্য বধূ হিসেবে অভিনয় করতে করতে মাঝেমাঝে যদিও তাঁর শহুরে ইন্টেলিজেন্সটা বেরিয়ে আসছিল, তবু মোটের ওপর খারাপ লাগেনি। মুখিয়ার ভূমিকায় টিগ্মাংশু ধুলিয়া এবং তাঁর ছেলের ভূমিকায় পঙ্কজ ত্রিপাঠী বেশ ভাল। দশরথের বাবা মগরুর ভূমিকায় আসরাফ উল হক্ ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন। সাংবাদিকের চরিত্রে গৌরব দ্বিবেদীও খুব ভাল। অবাক লেগেছে ইন্দিরা গান্ধীর চেহারার সঙ্গে দীপা শাহির অদ্ভুত মিল দেখে। কেউ ইন্দিরার বায়োপিক বানালে তাঁকে মাথায় রাখতেই পারেন, জমে যাবে।
তবে এই ছবি দশরথের, মানে নওয়াজের। রিয়েল দশরথকে নওয়াজ রিলে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাহাড়ের সঙ্গে তাঁর একক সংলাপগুলো অসাধারণ। হাসি-আনন্দ-দুঃখ-কান্না-বেদনা এইসব অনুভূতিগুলো নওয়াজ এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে হাঁ হয়ে গিয়েছি তাঁকে দেখে। তাঁর “শানদার, জবরজস্ত, জিন্দাবাদ” সংলাপটি মনে হয় দশরথের জীবনেরই মূলমন্ত্র ছিল। শুধুমাত্র নওয়াজের জন্যেই সিনেমাটা দেখা উচিৎ।
এত ভালোর মধ্যেও হল্ থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিল কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেল। পাহাড় কাটার পরে দশরথের কি হল, তার জীবনে কোনো পরিবর্তন ঘটলো কিনা, তার এই কান্ডে প্রশাসন এবং সরকারের কি রি- অ্যাকশন হল – এগুলোর একটা আভাস পেলে আরো ভাল হত। সিনেমার এন্ড টাইটল-এ শুধু জানা গেল ২০১১ সালে বিহার সরকার পাহাড়ে দশরথের নামে একটা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেটা বানাতে প্রায় ত্রিশ বছর লেগে গেল কেন, তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অবশ্য এটাও ঠিক, সব প্রশ্নের উত্তর এই একটা ফিল্ম দিয়ে দেবে, সেটা আশা করাও অন্যায়। প্রশ্নগুলো যদি ওঠে, সেটাই অনেক, তাহলেই এই ফিল্মের উদ্দেশ্য সার্থক।
কেতন মেহতার সাফল্য এখানেই। ক্ষুদ্র এক গ্রাম গেলৌর, সেখানকার ক্ষুদ্রতর এক গ্রামবাসী দশরথ মাঝির গল্প যে তিনি সারা দেশের মানুষের কাছে বলেছেন, লোকে যে সিনেমাটা দেখতে দেখতে, এবং সিনেমাহল্ থেকে বেরিয়ে দুদন্ড হলেও দশরথের কীর্তির কথা ভেবেছে, এটাই অনেক।
(ছবি উৎসঃ গুগ্ল্)