অনেকদিন বইপত্র নিয়ে কিছু লেখা হচ্ছে না। আসলে অফিসের কাজেকর্মে এত ফেঁসে আছি যে বই পড়াটাই লাটে উঠতে বসেছে। অবশ্য শুধু বই পড়া কেন, বারো ঘন্টা অফিসের জোয়াল টেনে মনের সব সুকোমল প্রবৃত্তিগুলো কিরকম যেন কর্কশ হয়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরি, তখন মাঝেমাঝেই মনে হয় হাতের সামনে যাকে পাবো, ধরে বেদম কেলিয়ে দেব। আমার মতন নিরীহ মানুষের মনে এরকম চিন্তাধারার উদয় হওয়াটা আমার নিজের এবং সমাজের পক্ষে যে মোটেই সুবিধের নয়, সেটাও বুঝি, কিন্তু আপাতত এর কোনো সুরাহার পথ দেখতে পাচ্ছি না।
এসব নিয়েই সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হচ্ছিল অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোককে আমরা আড়ালে ‘বাঘ’ বলে ডাকি। প্রথম প্রথম লোকটাকে অসহ্য লাগতো, কেননা অফিসে ঢুকেই তাঁর প্রথম কাজ ছিল আমাকে পাপড়িচাট বানিয়ে খেয়ে ফেলা। এমন সব অভিনব নিত্যনতুন ফিকিরে ভদ্রলোক চেটে দিতেন যে হুব্বা হয়ে বসে সেটা হজম করা ছাড়া আর কিস্যু করতে পারতাম না। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম ডিপার্টমেন্টের নতুন মুরগীদের সঙ্গে তিনি এরকম আচরণই করে থাকেন, এবং প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিলে লোকটাকে নেহাৎ মন্দ লাগবে না, এমনকি ভালও লাগতে পারে।
প্রতিদিন বিকেলের দিকে, এই চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ, বাঘ নিয়ম করে একবার ডিপার্টমেন্টে টহল দিতে বেরোন। উদ্দেশ্য, কে কি করছে দেখা, আর সুযোগ পেলেই কাউকে চেটে দেওয়া। তবে শুক্রবার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়। যারা ধোঁয়াটোয়া খায়, সেদিন তাদের নিয়ে সদলবলে বাঘ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে খানিক আড্ডা এবং গল্পগুজব করেন। এই সেশনটার নাম আমরা দিয়েছি ‘পাঠশালা’। ভদ্রলোকের জ্ঞানের রেঞ্জটা বিশাল – ক্ষীরকদম থেকে মিসিং ডেটা, ‘নীলি ছত্রিওয়ালে’ থেকে মার্কভ চেন, দশরথপুত্র রাম থেকে বুড়ো সাধু রম্, সব নিয়েই বকে যেতে পারেন। আমরা সেই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার থেকে যার যা পছন্দ সেটা তুলে নিই।
যাই হোক, যা বলছিলাম। সেদিন অন্য কেউ ছিল না, আমি একাই বাঘের জ্ঞানের প্রসাদ ভক্ষণ করছিলাম। একথা-সেকথার পরে পাহারপ্রমাণ কাজ আর ডেডলাইনের চাপের প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “আসলে কি জানো? কাজ তুমি দুইভাবে করতে পারো – অন্যকে ভয় দেখিয়ে, অমুক সময়ে কাজটা শেষ না করলে শাস্তির হুমকি দিয়ে, কাজটা করিয়ে নেওয়া, যেটা আমার মতে উগ্রপন্থা। অন্যটা হল সে যদি কাজটা না করে, তাহলে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কাজটা শেষ করা, যেটা আমার মতে আত্মশুদ্ধি”। আমি সিলেক্টিভ স্যামপ্লিং-এ বিশ্বাসী। এই গোটা ডায়ালগটা থেকে তিনটে শব্দ আমার মগজে ঢুকল, সঙ্গে একটা নতুন চতুর্থ শব্দ – নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ, আর গুডরীডস্(goodreads)। নিজের চেয়ারে ফিরেই গুডরীডস্-এর সাইটটা খুলে বসলাম।
গুডরীডস্ সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের নতুন করে কিছু বলার নেই, আর যাঁরা জানেননা, তাঁদের হাতেকলমে সাইটটা ঘেঁটে দেখতে অনুরোধ করছি। অনেক ভালভাল জিনিস আছে সেখানে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে রীডিং চ্যালেঞ্জ। বছরের শুরুতে আমি কটা বই পড়তে চাই, সেই সংখ্যাটা সেখানে দিতে হয়, তারপর কি বই পড়ছি তার নামটাও। এরপর বছরভর শুধু সময়মতো আপডেট করে গেলেই হল, বছরের শেষে জানা যাবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলাম কিনা। খেলাটা বেশ মজার, আর সবচেয়ে যেটা ভাল, সেটা হচ্ছে সারা বছর কি কি বই পড়লাম, বছরের শেষে গিয়ে তার লিষ্টটাও দেখা যায়।
এই বছরের তালিকায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম, আমি বছরটা শুরু করেছিলাম পামুকের ‘দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ দিয়ে। পাঠকমাত্রেই জানেন, পামুকের বই পড়াটা, এবং বোঝাটা, বেশ চাপের ব্যাপার। আমার কাছে আবার বোঝাটা অনেক সময়েই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এযাবৎকাল আমি পামুকের দুটো বই পড়েছি, আর খুব কষ্ট করে শেষ করেছি। অবশ্য তার মধ্যে ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসটা বেশ ভাল লেগেছিল। কিন্তু ‘দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ বইটা ঠিক আমার জন্য নয়। একমাস ধরে যুদ্ধ করে বইটা নামিয়েছিলাম বটে, কিন্তু শেষ করার পরে মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল।
শুরুটা অনেক প্রশ্ন দিয়ে শেষ হলেও, তারপর কয়েকটা ভাল ভাল বই পড়েছি। তার মধ্যে প্রথমে বলব ‘হট ওয়াটার’ বইটার কথা। পি জি উডহাউসের লেখা এই উপন্যাসটা খুব মজার। বর্ণময় সব চরিত্র আর তাদের অদ্ভুত সব কার্যকলাপে বইটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে। তার মধ্যে স্যুপ স্লেটারি আর অয়েলি কার্লাইল চরিত্রদুটো, তাদের নামের মতই, অভিনব এবং অনবদ্য।
শুরুতে বলেছিলাম, বই পড়াটা প্রায় লাটে উঠেছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, পড়া যত কমছে, কেনা ততই বাড়ছে। এতে আমার কোনো দোষ নেই, সব দোষ মুম্বইতে বছরে দুইবার হওয়া কিলোদরের বইমেলাটার। সেখান থেকেই এপ্রিল মাসে কিনেছিলাম মার্ক হ্যাডনের ‘আ স্পট অফ বদার’ উপন্যাসটা, আর সেটা পড়ার পরে বুঝলাম, দ্বিতীয় গল্পেও ভদ্রলোক তাঁর ম্যাজিকটা বজায় রেখেছেন।
হ্যাডনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ‘দ্য কিউরিয়াস ইন্সিডেন্ট অফ দ্য ডগ ইন দ্য নাইট টাইম’ বইটার মাধ্যমে। অটিস্টিক কিশোর ক্রিস্টোফার জন ফ্রান্সিস বুনের জবানীতে লেখা এই উপন্যাসটা আমার দুর্দান্ত লেগেছিল। তাই তাঁর দ্বিতীয় বইটা দেখতে পেয়েই বগলদাবা করে নিয়েছিলাম।
‘আ স্পট অফ বদার’-এর কেন্দ্রে আছেন জর্জ হল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বাতিকগ্রস্ত বুড়ো, শরীরে হওয়া ফুসকুড়িকে যিনি ক্যানসার ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি, তাঁর স্ত্রী জিন, তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে জ্যামি আর কেটি, কেটির হবু দ্বিতীয়পক্ষ রে আর প্রথমপক্ষের ছেলে জেকব, জ্যামির বয়ফ্রেন্ড টনি এবং জিনের প্রেমিক আর জর্জের সহকর্মী ডেভিড – এদের সবাইকে নিয়ে একটা ফাটাফাটি গল্প লিখেছেন হ্যাডন। আপাতদৃষ্টিতে হাসির মনে হলেও, হাস্যরসের আড়ালে অনেক গভীর বিষয় তুলে ধরেছেন লেখক। বইটা শেষ করেও তাই বেশ ধন্দে আছি, এটাকে কমেডি বলব, নাকি অন্যকিছু!
তবে পড়ার ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হল গোয়েন্দা আর রহস্য কাহিনী। এই বছরে যে কটা রহস্যকাহিনী পড়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল লেগেছে দুটো বই – পি ডি জেমস-এর লেখা ‘ইনোসেন্ট ব্লাড’ আর ডরোথি সায়ার্স-এর লেখা ‘মার্ডার মাস্ট অ্যাডভার্টাইজ’।
প্রথমে ‘ইনোসেন্ট ব্লাড’-এর প্রসঙ্গে আসি। এই কাহিনীর নায়ক পি ডি জেমস-এর বিখাত চরিত্র ইন্সপেক্টার ডার্গলিশ নন, এমনকি এটাকে ঠিক প্রথাগত ক্রাইম অ্যান্ড ডিটেকশনের গল্পও বলা চলে না। গল্পের নায়িকা ফিলিপা থাকে তার পালক মা-বাবার সংসারে। আঠারো বছর বয়সে পৌঁছে সে জানতে পারে যে তার আসল বাবামা খুনী – দশ বছর আগে একটা বাচ্চা মেয়েকে খুন করার অপরাধে তাদের জেল হয়েছে। তার বাবা জেলেই মারা গেছে, কিন্তু তার আসল মা এখনও জীবিত, এবং কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পাবে। ফিলিপা ঠিক করে জেল থেকে তার মাকে এনে তার সঙ্গে রাখবে। অন্যদিকে, কাহিনীর অন্যপ্রান্তে আছে নর্মান, খুন হওয়া মেয়েটির বাবা। এই দশ বছর ধরে সে ফিলিপার মায়ের প্রতিটা পদক্ষেপ নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করেছে। তার লক্ষ্য একটাই – যে ব্যক্তি তার মেয়েকে খুন করে বেঁচেবর্তে আছে, তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া।
গল্পটাকে তাই রহস্যকাহিনী না বলে একটা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বলাই ভাল। মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন, মায়ের আসল পরিচয় জানার পরে ফিলিপার নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ, মেয়ে হারানো বাপের দশ বছর ধরে পুষে রাখা প্রতিশোধস্পৃহা – জেমসের লেখনীতে এই সবকিছুই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের থেকে তাই এটা অনেকটাই আলাদা, একটা আলাদা স্বাদ পেলাম।
ডরোথি সায়ার্সের লেখা ‘মার্ডার মাস্ট অ্যাডভার্টাইজ’ গল্পটাও বেশ অন্যরকম। উপন্যাসের পটভূমি পিম’স্ পাবলিসিটি নামের একটি বিজ্ঞাপনের সংস্থা, যেখানে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় সেখানকার কপিরাইটারের। সেই মৃত্যু সম্পর্কে খোঁজখবর করতে আসেন লর্ড পিটার উইমসি, ডেথ ব্রেডনের ছদ্মনামে, আর বহাল হন সেই কপিরাইটারের পদেই। টুকটাক কপি লেখার ফাঁকে ফাঁকে লর্ড পিটারের রহস্য উন্মোচনের কাজও চলতে থাকে, আর সায়ার্স তৎকালীন অ্যাড দুনিয়ার একটা অপূর্ব ছবি তুলে ধরেন পাঠকের কাছে। তাই এই উপন্যাসকেও কোনোভাবেই রহস্য উপন্যাস বলা চলে না, বরং বলা ভাল এটি একটি এমন উপন্যাস যেখানে রহস্যের কিছু মালমশলা আছে।
উপন্যাসের পাশাপাশি কিছু ছোটগল্পও পড়েছি, আর তাদের মধ্যে তিনটে সংকলন খুব ভাল লেগেছে – মালগুডি ডে’জ, আতিশ তাসিরের অনূদিত মান্টোর একডজন গল্প আর রোয়াল্ড ডালের ‘কিস্ কিস্’।
ছেলেবেলায় ‘মালগুডি ডে’জ’ সিরিয়ালটা খুব প্রিয় ছিল, বিশেষ করে শুরুর সেই ‘তানা না তানা না না না’ গানটা। তবে গল্পগুলো এই প্রথম পড়লাম, এবং পড়ে বুঝলাম, লেখার দক্ষতা থাকলে সামান্যতম মামুলী দৈনন্দিন ঘটনাবলী থেকেও সুন্দর গল্প সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। গল্পগুলো কিছুদিন আমাকে আমার ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের সারল্যের মাধ্যমে।
মান্টোর ঘরাণা আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাঁর একেকটা গল্প যেন চাবুকের মতন আছড়ে পড়ে আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেকবুদ্ধির ওপর। এর আগে আমি মান্টো পড়িনি, আর গল্পগুলো ইংরেজীতে পড়তে পড়তে আক্ষেপ হচ্ছিল উর্দু জানিনা বলে। আতিশ তাসিরের অনুবাদ অবশ্য খুবই সুখপাঠ্য, তবে মূল ভাষায় পড়ার মজা নিশ্চয়ই আরো বেশিই হবে। ইচ্ছে আছে মান্টোর অন্যান্য গল্পগুলোও পড়ে ফেলার, তবে উর্দু তো আর শেখা সম্ভব না, তাই ইংরেজী কিংবা বাংলাতেই পড়ব।
রোয়াল্ড ডালের লেখাও প্রথমবারই পড়লাম। ‘কিস্ কিস্’ বইটার প্রচ্ছদে লেখা ছিল ‘expect the unexpected’, আর গল্পগুলো পড়ে মনে হল, প্রচ্ছদে মোটেই ভুল কিছু বলা হয়নি। ইংরেজিতে ‘ট্যুইস্ট এন্ডিং’ বলে একটা কথা আছে, প্রত্যেকটা গল্পে তার চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন লেখক। কয়েকটা গল্প শেষ করে গায়ে রীতিমত কাঁটাও দিয়েছে। তাই বইটা শেষ করেই আমাজন থেকে রোয়াল্ড ডালের গল্পের পুরো কালেকশনটা কিনে ফেলেছি। বাকিগুলোও তাড়াতাড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে।
বাংলা বই এবছর পড়া হয়নি বিশেষ, পুরনো-নতুন মিলিয়ে গোটা পাঁচেক পূজাবার্ষিকী ছাড়া। তবে সত্যি কথা বলতে কি, শারদীয়ার মান দিনদিন নেমে যাচ্ছে, স্রেফ অভ্যাসের বশে পড়ে চলি। সব মিলিয়ে গোটা পনেরো উপন্যাসের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ম্যাডাম ও মহাশয়’ ছাড়া একটাও মনে ধরলো না। সেটাও, কতটা যে গল্পের টানে আর কতটা শীর্ষেন্দুর প্রতি পক্ষপাতের জন্য, তা বলতে পারিনা।
(ছবি উৎসঃ গুগ্ল্)