দু’মাসের বেশী হয়ে গেল, ব্লগে একটাও পোষ্ট নেই!
পোষ্ট তো অনেক বড় ব্যাপার হয়ে গেল, নিদেনপক্ষে একটা একশ চল্লিশ চরিত্রের ট্যুইট হলেও বর্তে যায় বেচারা, কিন্তু সেটাও নেই। অবস্থাটা অনেকটা খরা-কবলিত লাতুর কিংবা মারাঠওয়াড়া অঞ্চল, যেখানে একফোঁটা বৃষ্টির আশায় মিলিসেকেন্ড গুনছে সেখানকার মানুষ। কদিন আগে অবশ্য জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর থেকে আশ্বাসবাণী শোনা গিয়েছে – এবারে নাকি একশ ছয় শতাংশ বৃষ্টিপাত হবে। প্রকৃতিও আজকাল পোলারাইজড হয়ে গেছে – হয় অতিবৃষ্টি, আর নইলে অনাবৃষ্টি, আর এই দুটোতেই যেটা কমন ব্যাপার, সেটা হল অনাসৃষ্টি।
কি আর করা! প্রকৃতির পক্ষপাত থেকে চোখটা সরিয়ে ব্লগটার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। হুব্বা হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলাম, এই দুই মাসে লিখিনি কেন? ব্যস্ততার দোহাই যে দেবো, তাতে নিজেরই লজ্জা করল। এমন কিছু রাজকার্য আমি করিনি এই দুইমাসে যে লেখার টাইম পাবনা। খানকতক গল্পের বই, ফাঁকিবাজি মেরে অফিস আর অপরিসীম ল্যাদ খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারিনি এই সময়টায়। তাহলে?
আরো মিনিট আড়াই ভাবার পরে যেটা বুঝতে পারলাম, সেটা হচ্ছে এই যে, আমার অবস্থা হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের নয়নের মতন। হঠাৎ একদিন নানাবিধ ভুলভাল চিন্তাভাবনা আমার মাথার মধ্যে উদয় হয়েছিল, তারপর ঠিক যেমন গরমকালের ঘামাচি বর্ষার আগমনে নিজেনিজেই মিলিয়ে যায়, সেরকমভাবেই এইসব উদ্ভট চিন্তাভাবনাগুলো মগজ থেকে মিলিয়ে গেছে। হ্যারি পটার পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ার পরে দেওয়ালটা যেরকম নিরেট হয়ে গিয়েছিল, আমার মাথাটাও সেরকম খাজা কাঁঠালের মতন নিরেটাকার ধারণ করেছে।
নিজের সম্পর্কে আমার মূল্যায়নগুলো প্রায়শই ঠিক হয়। তাই এক্ষেত্রেও ‘বুলস্ আই’ হিট করে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করলাম। কিন্তু বাধ সাধলো খবরের কাগজে বের হওয়া একটা খবর, যাতে বলা আছে যে মহারাষ্ট্র সরকার নাকি খরাকবলিত এলাকায় নকল বৃষ্টি নামানোর পরিকল্পনা করছেন, যার জন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বৈঠক ইত্যাদি ইত্যাদি।
খবরটা পড়ে আমার মাথার মধ্যেও পোকা নড়ে উঠলো। নকল বৃষ্টি মানে গোদা বাংলায় যাকে বলে জোর-জবরদস্তি বৃষ্টি নামানো। সেই একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমিও জোর-জবরদস্তি ব্লগে একটা লেখা নামাবো, সে সাপ-ব্যাং-সারদা-নারদা-কেষ্ট-বিষ্টু যা-ই হোক্ না কেন, আর সেটা আজই।
ব্যস, প্রণাম ঠুকে নেমে পড়লাম সেই কাজে।
যতটা খিল্লি বা তাচ্ছিল্য নিয়ে ‘প্রণাম’ কথাটা বললাম, জিনিসটা কিন্তু মোটেই ততটা হেলাফেলার নয়। বঙ্গজীবনে ভাতডালমাছ কিংবা বিশেষ্য-সর্বনামের মতন প্রণামেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। সারা জীবনে কতজনকে যে আমাদের প্রণাম করতে হয়, তার হিসেব নেই, গুনতে বসলে শেষ করা যাবেনা।
এমনিতে প্রণাম করা নিয়ে আমার অসুবিধে নেই। যাঁদের মন থেকে ভালবাসি, শ্রদ্ধাভক্তি করি, সম্মান করি, তাঁদের প্রণাম করতে আমার বরং ভালই লাগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রণামটা নেননা, বরং বুকে জড়িয়ে ধরে একটা ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ দেন, তাতে মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে যায়।
কিন্তু গোল বাধে যখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে, অচেনা কোনো মানুষকে, ব্যক্তিটি শুধুমাত্র বয়োঃজ্যেষ্ঠ বলে, তাঁকে প্রণাম ঠুকতে হয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, ছোটবেলা থেকে এমন অনেককে আমি প্রণাম করেছি যাদের আমি সেই একবারই দেখেছি। ব্যাপারটা আরো বেশী করে ঘটে কোনো অনুষ্ঠানবাড়িতে কিংবা গেট টুগেদার-এ।
দৃশ্যটা খুবই চেনা। মা-মাসী-পিসিদের মধ্যে কেউ এসে বলবেন, “শুনছিস, ইনি হলেন…” বলে নানাবিধ সম্পর্কের গলিঘুঁজি পেরিয়ে যেখানে থামবেন, সেখানে আমি পৌঁছতে তো পারবই না, উল্টে আমার মনের মধ্যে জেগে উঠবে সেই অনিবার্য প্রশ্ন – তাহলে ইনি আমার কিনি হলেন? প্রশ্নটা নিয়ে যে একটু ভাবব, তার ফুরসত পাওয়া যাবেনা, কেননা তারপর আমাকে হয় বলা হবে, “এঁকে প্রণাম কর”, নয়তো চোখ দিয়ে ইশারা করা হবে কাজটা করার জন্য।
প্রথমটা হলে ব্যাপারটা অল্পে চুকে যাবে। আমি টপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দেব, প্রাপক তাঁর ঝুলি থেকে একটা হাসি দিয়ে বলবেন, “ও মা! কত্ত বড় হয়ে গেছিস! আমাকে মনে আছে? আমি তোকে সেই তোর মুখেভাতের সময় দেখেছিলাম!” জবাবে আমি খানিক ‘হেঁ হেঁ’ করে কেটে পড়ব, বলা হবেনা যে মুখেভাতের সময় দেখলে আমার তাঁকে মনে থাকার কথা নয়।
কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাপারটা আমার পক্ষে খুব চাপ হয়ে যায়, কেননা চোখের ইশারাটিশারা আমি একেবারেই বুঝিনা। ফলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় খুবই অস্বস্তিকর। একদিকে যিনি পরিচয় করাচ্ছেন, পর্যায়ক্রমে চোখ ঘুরিয়ে আর ভুরু নাচিয়ে তাঁর চোখ আর ভুরু দুটোতেই ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সেটার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে আমিও ভুরু তুলে নিঃশব্দে কারণ জানতে চাইছি বা হাঁ করে ইশারাটা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কিন্তু সবচেয়ে বিপদে পড়েন তৃতীয়পক্ষ। হাসিহাসি মুখে একটা প্রণাম নেওয়ার জন্য তিনি মানসিকভাবে তৈরী, পাদুটো খানিক এগিয়েও এনেছেন, এমনকি আশীর্বাদে কি বলবেন সেটাও মনেমনে ছকে ফেলেছেন, কিন্তু আমার মতন গবেটের জন্যেই তিনি তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ছোটবেলায় এর জন্য মায়ের কাছে পরে যে কত কানমলা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
বিয়েবাড়ি হলে ব্যাপারটা আরো খোলতাই হয়, যার পুরোভাগে থাকে নববিবাহিত বর-বউ, আর প্রাপকের দলে থাকেন উভয়ের নিকটাত্মীয় এবং, ওই যাকে বলে, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। বাঙালিদের ‘এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি’ আক্ষরিক অর্থেই বৃহৎ এবং ব্যাপক। পাড়ার গেজেটেড পিসিমা থেকে পাশের বাড়ির কুচুটে মেজবৌ, পাড়াতুতো পিসেমশাই থেকে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড খাসনবিশ কাকু-কাকিমা – সক্কলে এই ট্যাগে বেশ ভালভাবে এসে যান। বিয়ের পরে বরবাবাজি বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলে তারপর থেকেই শুরু হয় এঁদের আনাগোনা। “অ্যাই ভুতো, তোর বউ দেখতে এলাম” বলে তাঁরা নববধূকে ঘিরে ধরেন, আর সদ্য নতুন পরিবেশে আসা মেয়েটি মুখে প্লাস্টিক হাসি লাগিয়ে প্রণাম করে চলে তাঁদের। বঙ্গ সংসারে নতুন বউ এই পাইকারি রেটে প্রণাম করে কতটা সুনাম কুড়োয় জানিনা, তবে সেটা না করলে যে অশেষ দুর্নামের ভাগীদার হয়, সেটা বলাই বাহুল্য।
এই প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধুর করুণ অভিজ্ঞতার কথা একটু বলা যাক। অনেক পুরনোদিনের বন্ধু, তাই ওর বিয়েতে প্রচুর হল্লাহাটি করে বউভাতের পরেরদিনই ফের হানা দিয়েছিলাম, ফুলশয্যা কেমন হল জানার জন্য। গিয়ে দেখি বন্ধু ছাদের এককোণে বসে চুপচাপ সিগারেট টানছে, দৃষ্টি উদাস। জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে ব্যাটা, কাল রাতে বেড়াল মারলি?”
একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধু বলল, “কই আর মারতে পারলাম! গত তিনদিন ধরে প্রায় দুশো লোককে পেন্নাম ঠুকে ঠুকে আমার বৌয়ের মাসাক্কালি কোমরে খিঁচ ধরে গেছে। কাল সব মিটে যাওয়ার পরে ঘরে এসে সেই যে কোমরে আইসপ্যাক ঠেসে ধরেছে, এখনও নামায়নি। শালা, ভাল লাগে বল? কালকের রাতটা কি আর ফিরে আসবে?”
বন্ধুর জন্য সত্যিই খুব কষ্ট হল। ওর বউয়ের জন্যেও! বেচারী এখন প্রণামের প্রণামী সামলাতেই ব্যস্ত।
শেষ করার আগে একটা ঘটনার কথা বলি। এটা অনেক পুরনো, প্রায় বছর পঁচিশ আগের। সচরাচর এতদিন আগেকার ঘটনাবলী আমার মনে থাকেনা, কিন্তু কেন জানিনা এই ঘটনাটা এখনও আমার মনে থেকে গেছে। পরিবারের সকলে মিলে যাওয়া হয়েছিল আমার বড়কাকুর বাড়িতে। বারাকপুর স্টেশন থেকে বাসে করে দেবপুকুর, তারপর সেখান থেকে রিকশা বা পায়ে হেঁটে গনেশপুর গ্রামে কাকুর বাড়ি। এখন যদিও জায়গাটা প্রায় শহর হয়ে গেছে, আর এত কসরত করে যেতেও হয়না, স্টেশন থেকেই অটো পাওয়া যায়, কিন্তু বছর পঁচিশেক আগে জায়গাটা বেশ প্রত্যন্ত গ্রামই ছিল। কারেন্ট থাকার তো প্রশ্নই নেই, বরং কাকুর বাড়ির পাশেই ছিল একটা বাঁশবাগান, আর সন্ধ্যা হলেই সেখান থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। কুপি আর হ্যারিকেনের আলোয় বেশ একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ তৈরি হত, আর বড়জেঠুর কাছে সবাই মিলে ভূতের গল্প – বেশ জমে যেত পুরো ব্যাপারটা।
বড়কাকুর বাড়ি থেকে একটু দূরেই ছিল কানুকাকুর বাড়ি। মূলত বড়কাকুর বন্ধু হলেও, সদাহাস্যময় এই মানুষটির সঙ্গে আমাদের সবারই জানাশোনা ছিল। আমাকে এবং আমার খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাই-বোনেদেরও তিনি খুব ভালবাসতেন, দেখা হলেই পালা করে আমাদের সবাইকে সাইকেলে চড়াতেন।
সেবার কি একটা উপলক্ষ্যে কানুকাকুর বাড়িতে আমাদের সবার নিমন্ত্রণ ছিল। বেশ জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। কানুকাকুর মা আমাদের জন্য প্রচুর রান্নাবান্না করেছিলেন। যত্নসহকারে আমাদের সবাইকে খাওয়ালেন – খাবারের স্বাদ ছিল অসাধারণ – এমনকি গরমে আমাদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য ঠায় বসে থেকে আমাদের তালপাখা দিয়ে হাওয়াও করলেন। ভদ্রমহিলার বয়েস তখনই প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, কিন্তু তাঁর উৎসাহে-উদ্যমে সেটা বোঝাই যেত না।
আমরা যখন বেরোব-বেরোব করছি, জনৈক মুখুজ্যেমশাই এলেন কানুকাকুর বাড়ি। বয়স্ক লোকটির হাবেভাবে বেশ একটা মুরুব্বি-মুরুব্বি ভাব ছিল, হয়তো কোনো মোড়লগোছের হবেন, চোখেমুখেও বেশ একটা ঘোড়েলভাব ছিল। কানুকাকুর মা তাঁকেও প্লেটভর্তি খাবার দিলেন – লুচি, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি। মুখুজ্যেমশাই অল্প খুঁটে খেলেন, বাকিটা প্রসাদ করে রেখে দিলেন। এরপর দেখি, আমাদের বাড়ির সবাই ঢিপঢিপ করে তাঁকে প্রণাম করলেন। বাড়ির বড়রা কাউকে প্রণাম করলে ছোটদেরও করতে হয়, সেটাই নিয়ম, তাই আমরাও বাদ গেলাম না।
বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা মা, তোমরা সবাই মুখুজ্যেমশাইকে প্রণাম করলে কেন? ওঁকে কি চেনো?”
মা বলেছিলেন, “না, সেদিনই দেখলাম। খারাপ কি, বয়স্ক মানুষ, প্রণাম তো করাই যায়। তবে ব্যাপারটা কি জানিস, সেদিন কানুবাবুর মা আমাদের সবার যা যত্ন করেছিলেন, আমাদের সকলেরই উচিৎ ছিল তাঁকে একটা প্রণাম করা”।
“করলে না কেন?”
“কি করে করব? আর কেউ তো করেনি। আমি তাঁকে প্রণাম করলে অন্যরা হয়তো ইচ্ছা না থাকলেও কাজটা করতে বাধ্য হত। সেটা হয়তো অনেকেরই ভাল লাগতো না, কানুবাবুরা তো আর ব্রাহ্মণ নন”। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বলেছিলেন, “সংসারে যার যেটা প্রাপ্য, অনেকেই সেটা পায়না, আবার অনেকেই অযাচিতভাবে অনেককিছু পেয়ে যায়, যোগ্যতা না থাকা সত্বেও। বড় হ’, বুঝবি”।
কচি বয়েস আমার তখন, তাই সেই বৃদ্ধার জন্য খুব খারাপ লেগেছিল । মনে মনে ঠিক করেছিলাম, পরেরবার বড়কাকুর বাড়ি গেলে টুক করে গিয়ে তাঁকে একটা প্রণাম করে আসব। কিন্তু পরেরবার যখন গেলাম, শুনলাম তার কিছুদিন আগে তিনি মারা গিয়েছেন।