পুজোর নস্ট্যালজিয়া

“যা দেবী সর্বভূতেষু, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা…”

যেদিন ভোরবেলা রেডিওতে এক অননুকরণীয় কন্ঠস্বরে ওপরের লাইনটা বেজে ওঠে, সেইদিন থেকেই দুর্গাপূজার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়। তার আগে কয়েকটা রোববার জুড়ে গড়িয়াহাট-হাতিবাগানে পুজোর শপিং-এর জন্য যত ভীড়ই হোক না কেন, মহালয়ার স্তোত্রপাঠটা না হলে যেন পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে না ঠিকঠাক।

আমাদের বাড়িতে সন্তোষের একটা বড় রেডিও ছিল। তখনও এফএম আসেনি মার্কেটে, কাজেই রেডিওটা তখন প্রায় শো-পিস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহালয়ার দুই-তিনদিন আগে থেকে ওটাকে তাক থেকে নামিয়ে ঝাড়পোঁছ করা হত, তারপর চালিয়ে দেখা হত, যাতে মোক্ষম সময়ে বাছাধন বিগড়ে না যায়। মহালয়া শোনাটাও বেশ ঘটার ব্যাপার ছিল তখন। মনে আছে, আগেরদিন রাতে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া হত, যাতে ভোরবেলায় সবাই উঠে পড়তে পারে। চারটের সময় অ্যালার্ম বেজে উঠলেই মা আমাকে টেনে তুলে দিত। তারপর রেডিওটাকে মাঝখানে রেখে সবাই ওকে ঘিরে গোল হয়ে বসতাম। ওকে দেখে মনে হত ঠিক যেন কোনো ভিআইপি! আমি তখন নেহাৎই ছোট, ঘুমচোখে ঢুলতে ঢুলতে বাবা-মা-কাকু-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার সাথে বসে মহালয়া শুনতাম। পাড়ার অন্যান্য বাড়ি থেকেও গমগমে স্বরে স্তোত্রপাঠ ভেসে আসত। একটা অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে যেত।

আমার মহালয়া ভাল লাগার কারণটা সহজেই অনুমেয় – তার দিনপাঁচেক পরেই পুজো, আবার মহালয়ার দিন থেকেই ফুর্তির-প্রাণ-গড়ের-মাঠ হয়ে ওঠা হতনা তার কারণ – স্কুলে তখন হাফ্‌-ইয়ার্লি পরীক্ষা চলতো! ইতিহাস-ভূগোল-অঙ্ক-বিজ্ঞান নিয়ে আমি হাঁসফাঁস করতাম, আর পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে দেখতাম, পাড়ার প্যান্ডেলটা একটু একটু করে তৈরী হচ্ছে। তখন ষষ্ঠীর আগে দেবীর মুখ দেখানো হতনা, আর এখনকার মতন চতুর্থীর দিন থেকেই লোকজন ‘প্যান্ডেল হপিং’-এ বেরিয়ে পড়তো না। তাই পরীক্ষা চলাকালীন এইটুকু সান্ত্বনা অন্তত থাকতো যে আমাকে বাদ দিয়ে কেউ ফাঁকতালে ঠাকুর দেখে নিচ্ছে না।

চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন পরীক্ষা শেষ হত। সেদিন স্কুলে যেতে আর ইচ্ছে করতো না, অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতাম স্কুলের দিকে। ফেরার পথে মনের খুশী আর ধরতো না! বাসে আসতে আসতে ভাবতাম, কখন বাড়ি গিয়ে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা আর শুকতারাটা শুঁকেটুঁকে দেখবো, আর পুজোতে পাওয়া নতুন জামাকাপড়গুলো বিছানার ওপর ডাঁই করে ছড়িয়ে ঘাঁটবো। মা দ্বিতীয় বিষয়টা মোটেই পছন্দ করতো না, কিন্তু তখন আমার পরীক্ষা শেষ, পুজোর ছুটি শুরু হয়ে গেছে, কাজেই আমাকে তখন আর পায় কে! তার ওপর সেই সময়ে বাবা বাড়িতে থাকলে তো কথাই ছিলনা, দেদার প্রশ্রয় মিলতো।

সপ্তমীর দিন সকাল থেকে মোটামুটি বাড়িতে শোরগোল পড়ে যেত। দূরের এবং কাছের সব আত্মীয়স্বজনরা আসতেন বাড়িতে। জেঠু-কাকু-জেঠিমা-কাকীমা-খুড়তুতোজ্যাঠতুতো ভাইবোন – সব মিলিয়ে এক হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার শুরু হয়ে যেত। শত দুষ্টুমিও তখন মাফ হয়ে যেত, সারাদিন ভাইবোনেদের সঙ্গে হুল্লোড়বাজি, খুনসুটি, খেলা, মারামারি এইসব চলতো। প্রতি বছর ষষ্ঠীর দিন ক্যাপ ফাটানোর পিস্তল কিনতাম আমরা ভাইয়েরা, সঙ্গে ক্যাপের রোল। দিদিটা বেজায় ভীতু ছিল, তাই ওর কানের কাছে প্রচুর ক্যাপ ফাটানো হত। দিদি যত রেগে যেত আর ভয় পেত, আমাদের আনন্দ হত তত বেশী!

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে বড়রা একটু গড়িয়ে নিতেন, আমরা তখন সমান উদ্যমে ক্যারম, লুডো, চোর-পুলিশ-বাবু-ডাকাত খেলতাম। তারপর ঘড়ির কাঁটা চারটের দিকে এগোলেই ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না শুরু হয়ে যেত।

তখন শুরু হত সাজগোজের পালা, আবার একপ্রস্থ হৈচৈ। আমরা ছোটরা চেষ্টা করতাম এক ডিজাইনের জামা পড়তে। তারপর সেজেগুজে, পকেটে বন্দুক গুঁজে রেডি হয়ে থাকতাম। সবার সাজগোজ শেষ হলে ঠাকুর দেখতে বেরোনো হত। কুড়িজনের একটা দল ছিল আমাদের, ছোট-বড় সব মিলিয়ে।

তখনও থিম-পুজোর জন্ম হয়নি, সাবেকি স্টাইলের প্রতিমাই গড়তেন কারিগরেরা। উল্টোডাঙ্গার আশেপাশে তেলেঙ্গাবাগান, ধরবাগান, করবাগান, যুব বৃন্দ তখনও ‘এলিট’ গ্রুপের কল্কে পায়নি, বরং ওই চত্বরে তখন সবচেয়ে বেশি লোক টানত গৌরীবাড়ি, হাতিবাগান আর বাগবাজারের পুজো তিনটে। তবে ছোটবেলা থেকেই কটা ঠাকুর দেখা হল এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। আমার ভাল লাগতো এই সাজ-সাজ রব, আয়োজন, হুল্লোড় আর সঙ্গে অতি অবশ্যই, খাওয়াদাওয়াটা।

পুজোর ওই দিনগুলোতে সব খাবারেরই যেন অন্যরকম স্বাদ ছিল! নইলে পাড়ার গোবিন্দর দোকানের যে লাল-লাল ভেজিটেবিল চপগুলো সারা বছর আমি ছুঁয়েও দেখতাম না, সপ্তমীর দিন সবার সঙ্গে বেরিয়ে সেটাকেই অমৃত মনে হত। মনে হত, গোবিন্দর ভেজিটেবিল চপ না খেলে যেন যাত্রা শুরুই হবেনা। শুধু কি চপ, কাঁচা পরোটা দিয়ে বানানো এগরোল, আধসেদ্ধ চালের বিরিয়ানি, অর্ধেক ভাজা ফিসফ্রাই – সবই তখন স্বর্গীয় মনে হত।

একবার মনে আছে, অষ্টমীর দিন মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখে বেরিয়ে হাল্কা খিদে পেয়ে গিয়েছিল, রাত তখন দেড়টা হবে। বাবামা, জেঠু-জেঠিমা আর খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে পার্কের উল্টোদিকের একটা মিষ্টির দোকানে গরম দুধে গরম জিলিপি ডুবিয়ে খেয়েছিলাম, তার স্বাদ যেন এখনও লেগে আছে মুখে!

খাওয়াদাওয়া আর হাহাহিহি করতে করতে প্রতিবার যে আমাদের ফ্যামিলি ব্যাটেলিয়ান বাগবাজার অবধি পৌঁছতে পারতো, তা কিন্তু নয়। হাতিবাগান অবধি পৌঁছেই হয়তো সবাই হাঁপিয়ে গেল, তখন ঠাকুর দেখার লাইনে না দাঁড়িয়ে লাইন দেওয়া হত মালঞ্চের সামনে। লাইন দিয়ে ঢুকে, বেশ জমিয়ে ফিসফ্রাই-কবিরাজী ইত্যাদি সাঁটিয়ে বেরোতে বেরোতে মোটামুটি দুইঘন্টা কাবার হয়ে যেত। তখন আবার হাহাহিহি করতে করতে বাড়ির পথে হাঁটা লাগানো হত।

অষ্টমীর দিনটাও সবাই মিলে বেরোতাম। সেদিন আমাদের টার্গেট থাকতো উত্তর আর মধ্য কলকাতা। সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর মাঠে একটা সুন্দর মেলা হয় পুজোর সময়, সেখানে জলবেলুন কিনতাম। আরো একটা ব্যাপার আমার মনে আছে। সিমলার মন্ডপের অসুরটাকে যেন একটু বেশি গাট্টাগোট্টা বলে মনে হত, আমি ভাবতাম অসুরটা সমিতিতে ব্যায়াম করে বলে বুঝি ওইরকম স্বাস্থ্য!

নবমীর দিন দুপুরে পাড়ার প্যান্ডেলে ভোগ খাওয়াত। প্রায় প্রতিবছরই একইরকম মেনুঃ পোলাও, লাবড়া, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনী, রসগোল্লা আর পাঁপড়। তবে প্রতিবছর একই খাবার খেলেও খারাপ লাগতো না, বরং মাঝেসাঝে মেনু বদলে গেলে রাগই হত। সন্ধ্যাবেলা কোনো কোনো সময় বাবামায়ের সঙ্গে সল্টলেকে মাসির বাড়িতে যেতাম। সল্টলেকের পুজোয় তখন ‘বহিরাগত’ জনতা বেশি ছিলনা। ব্লকের পুজোর দর্শক মোটামুটি সেই ব্লকের জনতার মধ্যেই সীমিত থাকতো। তবে পরিস্থিতি বদলে গেল যেবার ‘টাইটানিক’ সিনেমা বেরোনোর পরে সল্টলেকের কোনো একটা ব্লকে জাহাজের আদলে প্যান্ডেল বানানো হয়েছিল। সেবারেও আমরা নবমীর দিন মাসির বাড়ি গিয়েছিলাম, টাইটানিক দেখতে। অস্বাভাবিক ভীড় হয়েছিল সেইবার, যার বেশিরভাগই বহিরাগত।

ততদিনে অবশ্য আমার ছোটবেলাও শেষ হয়ে গিয়েছিল, আর পুজোর আকর্ষণটাও বদলাতে আরম্ভ করেছিল আস্তে আস্তে। মাটির মূর্তির বদলে জীবন্ত প্রতিমাদের দিকে মনোযোগ থাকতো বেশি। চোরা চোখে তাদের সাজপোশাক আর যা যা দর্শনীয়, বয়েসের ধর্ম অনুযায়ী সেগুলো দেখতাম।

আরো বড় হওয়ার পরে অষ্টমীর দিন থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বেরোতাম, তবে প্যান্ডেল হপিং-এর বদলে আড্ডাই মারা হত বেশি – কখনও কফিহাউস, কখনও অলিপাব, কখনও ম্যাডক্স আবার কখনও বা পিটারক্যাটে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, কখনও কখনও মাঝরাত অবধি আড্ডা চলতো। বাড়ির বড়দের বয়েসও বাড়ছিল, ফলে আমাদের সপ্তমীর দিনের পারিবারিক পুজো পরিক্রমাটা বাগবাজারের বদলে হাতিবাগান, তারপর খান্না আর তারওপরে গৌরীবাড়ি অবধি কমে এসেছিল। কিন্তু একসঙ্গে বেরোনোর সেই উৎসাহটা সবার মধ্যে ছিল, যার ফলে কতদূর গেলাম, সেটার চেয়ে একসঙ্গে সকলে মিলে হৈহৈ করে চলার আনন্দটাই মুখ্য ছিল।

কলকাতায় শেষ পুজো কাটিয়েছি দশ বছর আগে। তারপর দেশে এবং বিদেশে নানা জায়গায় পুজো দেখেছি, সেখানে পুজোর আয়োজনও করেছি। কিন্তু দুর্গাপুজো এলেই যে ছবিটা এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হচ্ছে গোবিন্দর দোকানের ভেজিটেবিল চপ খেতে খেতে হাহাহিহি করতে করতে বাড়ির সবাই মিলে বেরোনোটা। আর বেরোনোর আগে ঠাকুমার কপালে হাত ঠেকিয়ে “দুগ্‌গা দুগ্‌গা” বলাটাও।

কিছু কিছু ছবি যত পুরনো হয়, তত যেন আরো বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে!

জয় মা দুর্গা!

132_bagbazar4(ছবি উৎসঃগুগ্‌ল্‌)

 

2 thoughts on “পুজোর নস্ট্যালজিয়া

  1. Siddhartha সেপ্টেম্বর 29, 2014 / 1:42 অপরাহ্ন

    Darun darun…. puro flash back e phire gelam… really nostalgic… Saltlake er pujo ta FD block er… haan eta ekdom thik je jobe theke jibonto pratima der dekhte shuru korlam, tobe theke pujor sei aamej ta aar thaklo na…:)

    • অরিজিত সেপ্টেম্বর 29, 2014 / 9:36 অপরাহ্ন

      সত্যিই রে, ছোটবেলার পুজো সত্যিই নস্ট্যালজিক। 🙂
      এফডি ব্লকের কথা তোর মনে আছে দেখছি! আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান