মদ ও মাতালের গল্প

মদ জিনিসটাকে কে ষড়রিপুর তালিকায় যুক্ত করেছিল জানিনা, তবে সেই তালিকাভুক্ত হওয়ার ফলেই মনে হয় বেচারা কোনোদিন বাঙালির গৃহস্থজীবনে কল্কে পেলনা, একেবারে ব্ল্যাকলিস্টেড হয়েই রয়ে গেল। মদ  সম্পর্কে ধ্যানধারণাগুলোও বেশ একপেশে – খারাপ ছেলেমেয়েরাই মদ খায়, মদ খাওয়া মানেই বখে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক অভিভাবকদের এও বলতে শুনেছি যে যারা মদ খায়, তাদের তাঁরা ঘৃণা করেন। ড্রয়িংরুমে বসে টিভির পর্দায় ভ্যাট সিক্সটি-নাইনের বোতল হাতে টলতে থাকা উত্তমকুমারকে দেখে তাঁরা বেশ মজা পান, কিন্তু ঘরের ছেলেমেয়ে পাপ্পুকুমার-পুপ্‌লুকুমারী মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকেছে শুনে তাঁরাই অভিমানে দোর দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

আমার এক দুরসম্পর্কের মাসী যেমন। একটি বহুজাতিক সংস্থার উদীয়মান এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন। বিয়ের পরে কিছুদিন অবধি জামাইয়ের গর্বে বেশ গরবিনী ছিলেন। কিন্তু যে মুহুর্তে মেয়ের মুখে শুনলেন যে জামাই ড্রিঙ্ক করে, সেই মুহুর্তেই তাঁর গর্ব হতাশায় পরিণত হয়েছিল, আর উজ্জ্বল নক্ষত্রটি হ্যারিকেনে। স্টিম ইঞ্জিনের মতন ফোঁস করে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেছিলেন, “বাবা! এইসব গুণও আছে? ওকে তো ভাল ছেলে বলেই জানতাম!”

দিদি অবাক হয়ে বলেছিল, “ওঃ মা! ড্রিঙ্ক করা মানেই কি খারাপ?”

“তবে নাতো কি? তা সপ্তাহে কদিন ওইসব ছাইপাঁশ গেলা হয়?”

“মা, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায়না! কদিন আবার কি? মাঝেসাঝে অফিসে পার্টি হয়, সেখান থেকে একটুআধটু খেয়ে আসে”।

মাসী মুখটুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন, “তাও ভাল! তা ওসব গিলেকুটে এসে কিছু করেটরে না তো?”

দিদি ভীষণ অবাক হয়ে বলেছিল, “কি আবার করবে?”

“এই তোর ওপর চোটপাট, হম্বিতম্বি, মারধোর ইত্যাদি। চারদিকে যা সব শুনি!”

এই কথা শুনে দিদি হাসতে হাসতে বলেছিল, “কি যে বলনা মা! ও খাঁটি বিলিতি জিনিস খায়, ওসব খেয়ে কেউ মাতলামি করে?”

মাসী এই আশ্বাসবাণীতে মোটেই খুশি হননি, বরং চোখ পাকিয়ে “মাতালের ওপর খুব যে দরদ দেখছি! ওইসব ছাইপাঁশ আবার নিজে যেন না গেলা হয়” বলে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। জনান্তিকে ‘মোদো-মাতাল’ জামাইয়ের প্রতি রাগে আর মেয়ের দুর্ভাগ্যের প্রতি দুঃখে ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিলেন, কে জানে!

এই গল্পটা আমাকে দিদিই বলেছিল, জামাইবাবুর সামনেই। এটা শুনে জামাইবাবু হোহো করে হাসতে হাসতে বলেছিল, “মাতালদের সব্বাই ভয় পায়, বুঝলি কিনা? ভাগ্য ভাল যে উনি আমাকে পুলিশে দেননি!”

তবে মদের ভালমন্দ বিচার করতে আমি বসিনি। পছন্দ-অপছন্দ যার-যার নিজের ব্যাপার। তবে এই প্রসঙ্গে ইন্সপেক্টর পাকড়াশীকে বলা প্রবীর রায়চৌধুরীর একটা ডায়লগ আমার খুব ভাল লাগে, সেটা হল “অ্যালকোহল খুব ভাল জিনিস, তোর বাবা নিতে পারেননি, সেটা তাঁর প্রবলেম, অ্যালকোহলের নয়”।

এক বন্ধুর কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে। মদ খেয়ে বাড়িতে ঢোকার পরে ওর বাবা যখন তুমুল চোটপাট করছেন, বন্ধু তখন মধুর হেসে বলেছিল, “আঃ বাবা, চেঁচিয়ো না, নেশাটা ছুটে যাবে। তাছাড়া এত হল্লা কিসের? গিরীশ ঘোষও তো সোমরস খেতেন”।

বন্ধুর বাবা ওর চেয়ে এককাঠি ওপরে, তিনি বলেছিলেন, “বটেই তো! গিরীশ ঘোষ সোমরস খেয়ে নাটক লিখতেন, আর তুমি বাবা সোমরস খেয়ে তক্তপোশে নাটক কর, এটুকুই যা তফাত!”

এটা বেশ পুরনো ঘটনা, তখনও জিৎ গাঙ্গুলীর মাস্টারপিস্‌ “কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা” গানটা বাজারে আসেনি, তাহলে হয়ত বন্ধুটি আরো লাগসই কোনও রেফারেন্স টানতো, তবে সেক্ষেত্রেও ওর বাবা একটা যথোচিত উত্তরই দিতেন বলে আমার বিশ্বাস।

তবে যে যা-ই বলুক, মাতালদের আমার খুব ভাল লাগে – অবশ্যই বউ-পেটানো, কিংবা রাস্তাঘাটে মারপিট করা হিংস্র মাতাল নয়, ড্রয়িংরুমে বসে থাকা অহিংস মাতালই আমার পছন্দের। তাছাড়া বাঙালির আড্ডায় মাতাল একটা খুব কমন টপিক, আর সিনেমা-সাহিত্যেও ওদের নিয়ে চর্চা কিছু কম হয়নি।

আচ্ছা, কতটা মদ খেলে তবে মাতাল হওয়া যায়? এই প্রশ্নটা সহজ, তবে উত্তরটা ব্যক্তিবিশেষে বদলে যায়। কেউ দুই ছিপি খেয়েই মেঝেতে অ্যাটলান্টিক দেখে, আবার অনেকে আট পাত্তর চড়িয়েও একদম ‘দ্য ওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার এমনও কিছু পাবলিক আছে, যারা কিনা ‘আউট’ হওয়ার জন্যেই মদ খায় – হয় বোতল ওল্টাবে, নয় তারা নিজেরা ওল্টাবে, এরকম মনোভাব আর কি! এদের নিয়েই বেশ মুশকিল হয়। আমেজের ধার ধারেনা এরা, আকন্ঠ গিলে চোখটোখ উলটে পড়ে থাকাতেই এদের মোক্ষলাভ।

“আমি একদম ঠিক আছি” মোটামুটি সব মাতালেরই ফেভারিট একটা লাইন। টলমল পায়ে জগৎসংসার প্রায়ান্ধকার, কিন্তু মুখে সেই এক বুলি, “অ্যাই, আমাকে ধরবি না, আমি একদম ঠিক আছি”! এই কথা শুনে আমরা আমাদের এক বন্ধুকে বলেছিলাম, “কি করে বুঝব যে তুই ঠিক আছিস?”

বন্ধুটি, ধরা যাক তার নাম বিয়ার, বলল, “আমি এখন দুটো অঙ্ক কষব, সেটা দেখেই তোরা বুঝতে পারবি”। খাতা-কলম এগিয়ে দেওয়া হল, মেঝেতে বাবু হয়ে বসে বিয়ার বসল অঙ্ক কষতে। ঠিক দু’মিনিট, তার পরেই দেখা গেল বিয়ারের হাত স্থির, কলম স্থির, খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে বিয়ার নাক ডাকাচ্ছে!

স্কচ্‌ আর হুইস্কির ঘটনাটাও বেশ সরেস ছিল। সোস্যাল মিডিয়ায় আলাপ হওয়ার পরে প্রথম যেদিন ওদের দেখা হল, সেদিন অবধারিতভাবে ওরা একটা বোতল নিয়ে বসে পড়েছিল। বোতলের তিন-চতুর্থাংশ যখন শেষ, তখন স্কচ্‌ বলল, “গুরু, একটা গান গা, তুই কত্ত ভাল গান করিস”।

এই প্রস্তাবে হুইস্কি স্কচের দিকে তাকিয়ে বলল, “আহারে, তুই কি ভাল! তোর সঙ্গে আগে কেন দেখা হয়নি?”

স্কচ্‌ গদগদ হয়ে বলল, “হে হে হে! গুরু, একটা গান গা”।

হুইস্কিও আনন্দে ডগমগ হয়ে বলল, “গাইছি, কিন্তু তোর সঙ্গে আগে দেখা হয়নি কেন?”

এরকম বারপাঁচেক চলার পরে আশেপাশে যারা ছিল, তারা বলল, “ওরে তোরা থাম, একই কথা বলে যাচ্ছিস কেন?”

স্কচ্‌ একটু থমকে গিয়ে বলল, “গুরু, আমরা নাকি একই কথা বলছি! ধুস্‌ শালা, অনেক কথা হয়েছে, এবারে কথা বন্ধ। গুরু, তুই একটা গান গা, কি ভাল গান করিস তুই!”

হুইস্কির উত্তর, “গাইব তো, কিন্তু তুই আগে বল, তোর সঙ্গে আগে কেন আমার দেখা হয়নি?”

আমার বন্ধু ভদ্‌কার মদ খাওয়ার বিষয়ে নিজস্ব কিছু ফান্ডা ছিল। একবার সিভ্যাস রিগালের সঙ্গে রুহ্‌ আফজা আর অরেঞ্জ জুস্‌ মিশিয়ে একটা ‘কক্‌টেল’ বানিয়েছিল, যেটা আমরা কেউ খেতে সাহস করিনি, আর যেটা খেয়ে ওর সারা গায়ে র‍্যাশ বেরিয়েছিল। আরেকবার একটা ওয়াইন কুলার খেয়ে বেচারা নিজের শোবার ঘরটা খুঁজে পাচ্ছিল না।

তবে সবচেয়ে সরেস ঘটনাটা ঘটেছিল একবার বিজয়া সম্মেলনীর পার্টিতে। সেইদিন ভদ্‌কা নিজের ফান্ডা ছেড়ে নর্মাল তিনপেগ হুইস্কি টেনেছিল। জম্পেশ পানাহার করে আমরা সবাই বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্‌কা বলে উঠল, “ওই দ্যাখ, অষ্টমীর প্যান্ডেল! কি সুন্দর লাইটিং! কিন্তু প্রতিমাটা কোথায়, প্রতিমাটা?”

আমরা হতবাক্‌। আমাদের মধ্যে একজন বলল, “কিসব বলছিস? প্যান্ডেল কোথায়? লাইটই বা কোথায় দেখলি? টুনিবাল্ব জ্বলছে তো!”

ভদ্‌কা বলল, “টুনি! রাইট, প্রতিমার নাম টুনিই তো! ও টুনির মা, তোমার টুনিকে ডাকো না, এট্টু গল্প করি”।

বুঝলাম ওর মগজের টুনিবাল্বটা দপ্‌দপ্‌ করছে, যে কোনও মুহুর্তে নিভে যাবে। কথা না বাড়িয়ে ওকে টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। বাড়ি ঢুকে ও আমাদের হাত ছাড়িয়ে, “অ্যাই, আমি একদম ঠিক আছি। আমাকে জুতোটা রাখতে দে” বলে সটান রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। আমরা পিছুপিছু গিয়ে দেখি, ভদ্‌কা ফ্রিজের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে, আর বিড়বিড় করে বলছে, “যাশ্লা, শ্যু-র‍্যাকটা এত লম্বা হয়ে গেল কি করে? দরজাই বা এল কোত্থেকে? যাক্‌গে মরুকগে!”

তারপর আমাদের তিনজোড়া চোখের সামনে, ফ্রিজের মধ্যে জুতো রেখে, দরজাটা বন্ধ করে, বিজয়গর্বে আমাদের দিকে তাকিয়ে, মুচ্‌কি হেসে, ‘ও টুনির মা তোমার টুনি কাছে এলোনা’ গাইতে গাইতে, বেডরুমে ঢুকে পড়ল!

হতবাক্‌ ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই শুনতে পেলাম, ভদ্‌কার নাক ডাকছে।