গত দুই-আড়াইমাসে অনেকগুলো সিনেমা দেখে ফেলেছি। বাড়ির সামনে, একদম হাঁটাপথে, সিনেমাহল্ থাকার এই এক সুবিধে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ শনিরবির বিকেলে ভাতঘুম দিয়ে উঠে যদি সিনেমা পায়, টুকটুক করে হেঁটে চলে যাই হুমায়। টিকিট না পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, বরং আমাদের ক্ষেত্রে উল্টোটাই একবার হয়েছিল, ‘রয়’ দেখতে গিয়ে আমরা মাত্র দুজন দর্শক ছিলাম বলে আমাদের টিকিট দেয়নি। তাছাড়া হুমার অবস্থা অনেকটা একদা-ধনেখালি-এখন-ট্যাঁকখালির জমিদারবাড়ির মতন, চাকচিক্য নেই বলে জেন-ওয়াই খুব একটা আসেনা এখানে।
সিনেমা দেখার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সহিষ্ণু। একটা সিনেমা দেখা শুরু করলে আমি সেটা পুরোটা দেখার চেষ্টা করি, খুব কমক্ষেত্রেই এরকম হয়েছে যে সিনেমাটা আমি শেষ করতে পারিনি। আমার কেন জানিনা মনে হয়, এই যে এতজন মানুষ মিলে এত খেটেখুটে একটা সিনেমা বানায়, তাদের পরিশ্রমের দাম দেওয়ার জন্যেই আমার উচিৎ সিনেমাটা শেষ করা, গুণাগুণের বিচার তো আসবে তার পরে। তাছাড়া আমি এমন কিছু হনু লোক নই যে দুইঘন্টা জীবন থেকে চলে গেলে মহাভারত-রামায়ণ অশুদ্ধ হয়ে যাবে। এই গুণটা আমার গিন্নীর মধ্যেও আছে, কাজেই বেশ সুবিধেই হয়েছে বলতে হবে।
রোহিত শেট্টির ‘দিলওয়ালে’ সিনেমাটা দেখে অধিকাংশ দর্শকই খুশী হননি, শাহরুখ-কাজলের অন-স্ক্রীন রোমান্স দেখতে পাননি বলে। সিনেমার তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে রাজ ওরফে কালি-রূপী শাহরুখ আর মীরারূপী কাজল নিজেদের মধ্যে মারামারি করে গেছেন, প্রেমের দায়িত্বটা বরং পালন করেছেন বরুণ ধাওয়ান আর কৃতি শ্যানন।
আমার কিন্তু সিনেমাটা মন্দ লাগেনি, বরং ফুল্টু এন্টারটেনমেন্ট-মার্কা মনে হয়েছে। ভুললে চলবে না, ছবির পরিচালকের নাম রোহিত শেট্টি, তাই তাঁর পক্ষে যা সম্ভব, যতটা সম্ভব, এবং যেভাবে সম্ভব, তিনি সেভাবেই সেসব দেখিয়েছেন। নিজের ঘরাণা অনুযায়ী দামীদামী গাড়ি উল্টেছেন, স্ল্যাপস্টিক কমেডি রেখেছেন, মার্কামারা বোকাবোকা সংলাপ রেখেছেন, যা শুনে মাঝেমাঝেই মনে হয়েছে হাসব না কাঁদব! পুলকখুড়োর কথা অনুযায়ী, “আর কি চাই লালু বল্?” আমার তো রামলাল-পোগো, মণিভাই-অস্কারভাই, কিং ডন এদের বেশ লেগেছে। আড়াইঘন্টা ধরে এরকম হুল্লোড়বাজি দেখার পরে মনটা পুরো ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিল, সেটা বলতেই হবে।
অরিন্দম শীলের পরিচালিত ‘আবর্ত’ আর ‘এবার শবর’ দুটো ছবিই ভাল লেগেছিল। তাই তিনি যখন ব্যোমকেশকে নিয়ে ফিল্ম বানালেন, সেটাও আবার আমার অন্যতম প্রিয় একটা উপন্যাস ‘বহ্নি পতঙ্গ’ অবলম্বনে, তখন সেটা দেখার জন্য বেশ মুখিয়ে ছিলাম। এমনিতেই মুম্বইতে বাংলা ছবি বড় একটা আসেনা, তাই কালেভদ্রে যা দু’একটা এসে পড়ে, সেগুলো মিস্ না করারই চেষ্টা করি।
কিন্তু ছবিটা দেখে হতাশ হলাম।
অঞ্জন দত্তের ছবিতে ব্যোমকেশ হিসেবে আবীর যতটা শার্প, এখানে ঠিক ততটা লাগেনি। বাকি চরিত্ররাও তাঁদের যথাসাধ্য করেছেন, কিন্তু রহস্যটা ঠিক দানা বাঁধেনি। সাংসারিক আলাপচারিতা আর গীতগোবিন্দর ফাঁকে ফাঁকে দায়সারাভাবে যেন রহস্যভেদ হয়ে গেল, ঠিক জমলো না। তার ওপর প্রথম সিনে চলন্ত ট্রেনে ডাকাত ধরা আর শেষ দৃশ্যে গুন্ডা ঠ্যাঙ্গানো – এ দুটো না রাখলেও চলত।
এরপর আসি সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘বাজিরাও মাস্তানি’ ছবিটার কথায়। বনশালীর ছবি মানেই বিশাল বিশাল সেট, চমকদার সব পোশাক-আশাক আর দুজন নায়িকা থাকলেই যে-কোনোভাবে তাঁদের একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে নাচানো। এখানেও তার কোনো অন্যথা হয়নি। সেট – সে পেশোয়াদের বাসভবনই হোক বা যুদ্ধক্ষেত্রই হোক – দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। বড় পর্দায় দেখার আদর্শ ছবি একেবারে। বাস্তবে কাশীবাঈ আর মস্তানি কোনোদিন মুখোমুখি হয়েছিলেন কিনা জানিনা, তবে সঞ্জয় তাঁদের নিয়ে ‘পিঙ্গা’ গান বেঁধেছেন, এমনকি প্রবল পরাক্রমশালী বাজিরাওকেও ‘মল্হারী’ গানের তালে তালে একটা অদ্ভুত নাচ নাচিয়েছেন।
মরাঠি একজন সহকর্মীকে ফিল্মটার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে সে মাছি তাড়ানোর মতন ভঙ্গী করে বলেছিল, “সঞ্জয়ের কাছে সঠিক ইতিহাস আর ববি দেওলের কাছে হিট ফিল্ম – আশা করলেই ঠকবে”।
বোঝো!
তবে ইতিহাসের খামতিটা পুষিয়ে গেছে অভিনয়ে। প্রত্যেকে দারুণ অভিনয় করেছেন। দীপিকাকে দুর্দান্ত লেগেছে, দিনেদিনে তিনি নিজেকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই ছবির সবচেয়ে বড় চমক তন্ভী আজমি – ন্যাড়া মাথায় যে অভিনয়টা তিনি করেছেন, সেটা এককথায় অনবদ্য।
সন্দীপ রায় মূলত ফেলুদাকে নিয়ে সিনেমা বানালেও, কেন জানিনা তাঁর নন-ফেলুদা ফিল্মগুলোই আমার বেশী ভাল লাগে। ‘নিশিযাপন’ বেশ ভাল লেগেছিল, ‘হিটলিষ্ট’, ‘যেখানে ভূতের ভয়’ আর ‘চার’ ছবিগুলোও মন্দ লাগেনি। তাই ‘মনচোরা’ দেখার সুযোগ যখন পেলাম, ছাড়লাম না। তাছাড়া যে ছবির মুখ্য চরিত্রে আবীর, রাইমা, শাশ্বত আর পরাণ ব্যানার্জী থাকেন, সেই ছবি অন্তত একবার তো দেখাই যায়।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে বানানো এই ছবিটা বেশ মিষ্টি একটা প্রেমের গল্প, যেটা দেখার পরে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যাবে। সঙ্গে হাল্কা একটু রহস্যের বাতাবরণও আছে, তাই সবমিলিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার।
অক্ষয়কুমার লোকটার ওপর আমার খুব ভক্তি হয়। হবে না-ই বা কেন? যিনি ‘সবসে বঢ়া খিলাড়ী’ থেকে ‘হেরা ফেরী’, ‘আফলাটুন’ থেকে ‘ওঃ! মাই গড’, ‘সিং ইজ কিং’ থেকে ‘স্পেশাল ছাব্বিশ’ সমান দক্ষতায় নামাতে পারেন, তাঁর অভিনয়ের রেঞ্জ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা উচিৎ নয়, অন্তত আমার তো নেই।
তবে ‘এয়ারলিফ্ট’ সিনেমাটা আমি অক্ষয়ের জন্য দেখতে যাইনি, গিয়েছিলাম ছবিটার বিষয়বস্তুর জন্য। সত্য ঘটনা অবলম্বনে ফিল্ম আমাদের দেশে খুব কমই হয়, তাই এই ধরণের ছবিগুলো আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখি।
পরিচালক রাজাকৃষ্ণ মেনন ফ্যাক্ট এবং ফিকশন মিশিয়ে সুন্দর একটা কক্টেল তৈরি করেছেন, আর তার মধ্যে পরিমাণমত দেশভক্তিও মিশিয়েছেন। আম্মান এমব্যাসিতে যখন তেরঙ্গাটা শেষমেশ উড়লো, তখন আমার মতন নিরেটের চোখেও জল এসে গিয়েছিল। অভিনয়ে নিমরত কাউর থেকে শুরু করে খিটকেল জর্জ কুট্টির ভূমিকায় প্রকাশ বেলাওয়াড়ি, সকলেই মাতিয়ে দিয়েছেন, তবে বিশেষভাবে মনে ছাপ ফেলেছেন পূরব কোহ্লি। ছবির শেষে অবশ্য নতুন করে আবার অক্ষয়কুমারের প্রেমে পড়ে গেলাম। লোকজন বলছে এটাই নাকি অক্ষয়ের শ্রেষ্ঠ অভিনয়। শ্রেষ্ঠ কিনা জানিনা, তবে অসাধারণ অভিনয় করেছেন রাজীববাবু, সেটা বলতেই হবে।
বাংলায় গত এক-দেড় বছর ধরেই থ্রিলার এবং রহস্যকাহিনী অবলম্বনে সিনেমা তৈরির রমরমা। সবগুলোই যে উৎরোচ্ছে তা নয়, তবে কিছু সিনেমা বেশ ভাল হচ্ছে। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শুভ্রজিত মিত্র পরিচালিত ‘চোরাবালি’। আগাথা ক্রিস্টির লেখা ‘কার্ড্স অন দ্য টেবিল’ উপন্যাস অবলম্বনে এটি তৈরি হয়েছে। তবে পরিচালক মূল গল্পের কাঠামোটাকে এক রেখে বাকিটা নিজের মতন করে সাজিয়ে নিয়েছেন। গোয়েন্দাকে বদলে করেছেন অপরাধবিদ আর কিউরিও সংগ্রাহক এর বদলে এনেছেন ডাক্তারকে। তবে ভাল ব্যাপার এটাই যে বদলগুলো মোটামুটি খাপ খেয়ে গেছে ছবির আবহের সঙ্গে।
ছবির একেবারে শেষে গিয়ে পরিচালক নিজের মতন করে একটা ট্যুইস্টও রেখেছেন, যেটা অবশ্য না হলেও হয়তো চলত।
অভিনয়ে সবাই মানানসই। বরুণ চন্দ, জর্জ বেকার, তনুশ্রী চক্রবর্তী, লকেট চ্যাটার্জী, জুন মালিয়া, শতফ ফিগর, সমদর্শী দত্ত, মালবিকা ব্যানার্জী – সবাই বেশ ভাল অভিনয় করেছেন। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার আর ডাক্তারের চরিত্রে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নাম জানিনা, তবে ডাক্তার ভদ্রলোকের সঙ্গে যুবাবয়েসের অরিন্দম শীলের একটা মিল আছে।
শেষ করি ইমতিয়াজ আলির ‘তামাশা’ ছবিটার কথা বলে, কাকতালীয়ভাবে যেটা এই সবকটা ছবির আগে রিলিজ করেছিল। ছবিটা আমার খুব ভাল লেগেছে। আমাদের দেশের খুব প্রাচীন একটা আর্ট, যেটা কিনা এখন প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে, সেই ‘স্টোরিটেলিং’ বা মুখে মুখে গল্প বলা হল ছবিটার বিষয়বস্তু। তবে তার মাঝে বাণিজ্যিক ছবির চাহিদা অনুযায়ী নাচগান আছে, কর্সিকার দুর্দান্ত প্রকৃতি আছে, প্রেম-বিরহ-মিলন আছে, জগঝম্প নাচগানও আছে।
আর আছে রণবীর কাপুর আর দীপিকা পাডুকনের দুর্দান্ত কেমিষ্ট্রি। দুজনেই ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে যেখানে বেদ তা্র বাবাকে গল্প বলে শোনাচ্ছে, সেই সিকোয়েন্সটা জাস্ট ফাটাফাটি লেগেছে। গল্পবলিয়ের ভূমিকায় পী্যুষ মিশ্রও যথারীতি দারুণ। ছবির ন্যারেটিভটা শুরুতে একটু খটোমটো লাগলেও, সময়ের সাথে সাথে বেশ মানিয়ে গিয়েছে। পুরো ছবিটা দেখার পরে মনে হয়েছে যে এই ধরণের গল্প এভাবে বললেই বরং বেশী উপভোগ্য হয়।
ছবিটা ভাল লাগার আরো একটা কারণ আছে। বেদ আর তার অফিসের বস্-এর মধ্যে একটা কথোপকথন আছে, যেটা দেখে আমি স্রেফ ফিদা হয়ে গিয়েছি। দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, ইস্, আমিও যদি এরকম একটা তামাশা করতে পারতাম!
(ছবি উৎসঃ গুগ্ল্)
বাঃ। অনেকগুলো ছবির কথা। মজার ব্যাপার হলো, আমি একটাও দেখিনি। মাঝে কিছু অন্য সব ছবি নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম। এবারে হয়ত এগুলো দেখবো।
দেখো…তারপর জানিও কেমন লাগলো। 🙂
Monchora er Chpra bali dekha hoy ni. Baki gulo sob kotai dekhehcchi. Sob theke bhalo legechche “Airlift”. Baki movie gulao bhalo legechhce motamuti.
সেই…আমার সঙ্গে তোর ভাবনা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। 🙂
খুব সুন্দর ভাবনা, লেখা ও প্রকাশ, অসংখ্য ধন্যবাদ।
পড়ার জন্য, এবং প্রথমবার কমেন্ট করার জন্য, অনেক ধন্যবাদ রথীন্দ্রবাবু। 🙂